দেশের উচ্চশিক্ষায় এক ভয়ংকর আতঙ্কের নাম সেশনজট। এটি শিক্ষা কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে করে তোলে অনিশ্চিত। দেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের পেছনেও এটি বড় বাধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার সময় উলেস্নখ থাকলেও নির্ধারিত সময়ে এসব ডিগ্রি সম্পন্ন করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নগণ্য। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করতেই ৭ বছর পার হতে দেখা যায়। এ সমস্যা শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক প্রতিকূলতা তৈরি করে। সময়মতো শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাচ্ছেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে ক্রমাগত বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের প্রবণতা। তাই সেশনজটের সমস্যা যাতে আরও ঘনীভূত না হয়, সেদিকে আমাদের সবার সজাগ দৃষ্টি থাকা জরুরি।
সম্প্রতি ছাত্রজনুার অভু্যত্থানের ফলে দেশের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। প্রসঙ্গত, এ ঘটনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। চার মাস ধরে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমানে ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্বাভাবিক করার পেছনে বাধা সৃষ্টি করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ সংকটের মধ্য দিয়ে উচ্চ শিক্ষায় সেশনজট সমস্যা আরও বাড়বে। এই শূন্য পদগুলো দ্রম্নত পূরণ না হলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় দ্রম্নত ভিসি নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভু্যত্থান থেকে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছে, যা উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট সেশনজট এখনো মুক্ত হতে পারেনি। এরই মধ্যে এ বছর দীর্ঘ ৪ মাস ধরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে দেশের উচ্চ শিক্ষার মান ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা এক অশনিসংকেত হয়ে উঠেছে, যা আমাদের উচ্চশিক্ষায় ভবিষ্যৎ সাফল্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। তাই উচ্চশিক্ষায় সেশন জটমুক্ত করতে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে আসা সময়ের দাবি।
উচ্চশিক্ষায় সেশনজট নতুন সমস্যা নয়; এটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে আসছে। এ সমস্যা শিক্ষার্থীদের জন্য সময়মতো গ্র্যাজুয়েশন প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করে। সেশনজটের সৃষ্টির পেছনে অনেক কারণ দায়ী, এর মধ্যে : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পাঠ্যসূচির অনিয়ম, এবং অবকাঠামোগত অসুবিধা অন্যতম। তুলনামূলকভাবে নতুন চালু হওয়া বিভাগগুলোয় সেশনজট বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যার প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত অসুবিধাগুলোকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এসব বিভাগের শিক্ষক স্বল্পতা এবং ক্লাসরুমের সংকট রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং সমৃদ্ধির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়া বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা একাডেমিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভাগের দায়িত্বে থাকায় সেশনজট বাড়ছে বলে ধারণা করা হয়।
সেশনজটের সংকট উত্তরণে কিছু প্রতিষ্ঠান বেশ প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলাফলও এসেছে দারুণ, কিন্তু তাদের সংখ্যা অত্যন্ত সামান্য। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখন জটিলতা কমে এলেও শেষ হয়ে যায়নি। প্রতি ব্যাচের রয়েছে জট। নতুন করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এই সমস্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির একটি অন্যতম ক্ষতিকর প্রভাব হলো সেশনজট। শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ, ক্লাসে অনিচ্ছা, যথাসময় কোর্স শেষ না হওয়া এবং ফলাফল মূল্যায়নে বৈষম্য সেশনজটের উদ্ভব ঘটায়। সুতরাং সেশনজট দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে।
বর্তমানে দেশের সর্বত্র সংস্কার চলছে। উচ্চশিক্ষায় আর সেশনজট নয়, এটাই সবার দাবি। নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষা সেশন জটমুক্ত হলে সফলতা বাড়বে, শিক্ষার পথ সুগম হবে। তাই কার্যকর সমাধানের মাধ্যমে সেশনজট কমানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা যাতে সঠিক সময় তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে এবং চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারে। গঠনমূলক পর্যালোচনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আমরা দেশে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাই, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে এবং দেশের উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই যতদ্রম্নত সম্ভব সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ উপাচার্য নিয়োগে বিলম্ব হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা ফেরাতে বেশি সময় লাগবে এবং শিক্ষার মানও পিছিয়ে যাবে। পরিশেষে, সেশনজট মুক্ত উচ্চশিক্ষা হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক- এটাই প্রত্যাশিত।
মো. সাইফুল মিয়া
শিক্ষার্থী
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়