বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

পৃথিবী এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে

শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য পৃথিবীর সব দেশেরই একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী নিশ্চিত করা যায়।
হাসনাইন রিজেন
  ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
পৃথিবী এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে

বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির জটিলতার প্রেক্ষাপটে সাম্প্র্রতিক সময়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা অনেক বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক সংকট, চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা এবং পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি প্রদর্শন পৃথিবীকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ বা সংঘাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতের দুটি বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল সমগ্র বিশ্বের ওপর। অনেক জায়গার মানুষ এখনো সেই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পারেননি। এর মধ্যে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে পৃথিবী ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাবে। এই যুদ্ধে কে কোন দেশকে হারাবে আর কোন দেশ জিতবে সেটা মোটেও বড় কিছু নয়, কিন্তু যুদ্ধের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলে হেরে যাবে পুরো পৃথিবী! এই সামান্য আয়তন বিশিষ্ট পৃথিবী কি বহন করতে পারবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামের এই কলঙ্ক? থাকবে কী মনুষ্যের অস্তিত্ব নাকি মনুষ্যবিহীন জ্বলন্ত ছাই হিসেবে পরিণতি হবে আমাদের পৃথিবী?

বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত জটিল এবং অস্থির। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুধু ইউরোপেই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের ফলে যে বৈশ্বিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা থেকে নতুন কোনো বড় ধরনের সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি, বিশ্বকে একটি নতুন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

পাশাপাশি, চীন ও তাইওয়ান ইসু্যও বৈশ্বিক উত্তেজনার অন্যতম উৎস। চীন তাইওয়ানকে তাদের নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে এবং তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে তাইওয়ানের পক্ষ নিয়েছে, যা চীনের সঙ্গে তাদের সরাসরি সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, তাই এ ধরনের যেকোনো সামরিক সংঘাত বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যেও অস্থিরতা চলছে, বিশেষ করে ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা। ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে, যা ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্বের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে, যা আবার যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মতো বড় শক্তিগুলোকেও সংঘাতে জড়াতে পারে।

বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ এবং এর ব্যবহারের সম্ভাবনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে কৌশলগত উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, এবং অন্যান্য পারমাণবিক দেশগুলোর মধ্যে চলমান ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নতুন একটি যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। পারমাণবিক যুদ্ধ মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। একটি পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক যুদ্ধ পৃথিবীর পরিবেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে, খাদ্য ও পানির অভাব তৈরি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি রেডিয়েশন ক্ষতির কারণে মানুষের জীবনের জন্য একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে একেবারে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে ড্রোন, সাইবার যুদ্ধ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং স্বচালিত অস্ত্রব্যবস্থা যা বর্তমান যুদ্ধের কৌশলকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছে। এই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে সামরিক আক্রমণ করা সম্ভব হচ্ছে, যা যুদ্ধের প্রচলিত ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে সাইবার আক্রমণ একটি প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রগুলোর সামরিক এবং বেসামরিক অবকাঠামোর ওপর সাইবার আক্রমণ করে তাদের অক্ষম করে দেওয়া এখন একটি নতুন যুদ্ধ কৌশল। রাশিয়া এবং চীন ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রগামী এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণ চালানো হলে তা একটি বড় সংঘাতের সূচনা করতে পারে।

ভূ-রাজনৈতিক এবং সামরিক সংকটের পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাস্ফীতি, বাণিজ্য যুদ্ধ এবং জ্বালানি সংকট বিশ্ব অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলে জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে, যার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়েই নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বিস্তারের চেষ্টা করছে এবং এর ফলে তারা কৌশলগতভাবে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এই দ্বন্দ্ব যদি সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়, তবে তা কেবল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই নয়, বরং এক বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দিকে ধাবিত করতে পারে।

সমাধান, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সমঝোতা এবং সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বড় শক্তিগুলোকে পারস্পরিক স্বার্থে সমঝোতার পথে হাঁটতে হবে, যাতে কোনো সামরিক সংঘাত না ঘটে এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের হুমকি থেকে বিশ্ব মুক্ত থাকে। বিশ্বজুড়ে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমাতে আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধবিরতি এবং শান্তিচুক্তি নিয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বিশ্ব এখন একটি অত্যন্ত সংকটময় অবস্থায় রয়েছে, যেখানে সামান্য একটি ভুল পদক্ষেপই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে। ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা, সামরিক উত্তেজনা, পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি এবং অর্থনৈতিক সংকট মিলিয়ে বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তবে, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য পৃথিবীর সব দেশেরই একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী নিশ্চিত করা যায়।

হাসনাইন রিজেন, নবীন কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে