বিশ্ব শিক্ষক দিবস
শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতায় আমাদের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষ করে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছে না
অকুণ্ঠচিত্তে শ্রদ্ধা জানাই পৃথিবীর সকল শিক্ষককে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের কাছে একটি মহান দিনপঞ্জি হয়ে থাকুক চিরকাল- এই প্রত্যাশা
প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মো. রফিকুজ্জামান
আজ ৫ অক্টোম্বর 'বিশ্ব শিক্ষক দিবস'। স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপলস্নী রাধাকৃষ্ণের জন্মজয়ন্তী ৫ সেপ্টেম্বর। দেশের অগণিত শিক্ষকদের আদর্শগত মহান কর্মকান্ডের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের পেশাগত অবদানকে স্মরণে-বরণে শ্রদ্ধায় পালন করার জন্য সমগ্র বিশ্বের অনেক দেশে এই মহান শিক্ষকের জন্মদিনে শিক্ষক দিবস পালন করার রীতি থাকলেও ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ইউনেস্কো ৫ অক্টোবর দিনটিকে 'বিশ্ব শিক্ষক দিবস' ঘোষণা করে। এটি সারাদেশ-বিদেশে 'শিক্ষক' পেশাজীবীদের জন্য সেরা সম্মান।
স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপলস্নী রাধাকৃষ্ণ ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং 'ভারতরত্ন' উপাধিতে বিভূষিত। তিনি মহান দার্শনিক, আদর্শবান বিচারক ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন বাগ্মী, অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ এবং অদ্বৈত বেদান্ত বাদ রচয়িতা দার্শনিক। কথিত আছে তার কিছু প্রিয় ছাত্র ও অধ্যাপক বন্ধুবান্ধব, তার জন্মদিন পালন করতে আগ্রহান্বিত হলে রাধাকৃষ্ণ তাদের বলেছিলেন, 'আমার জন্মদিন পৃথকভাবে পালন না করে আমি গর্বিত হব, দিনটি যদি দেশের সমস্ত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়।'
বলাবাহুল্য আমাদের শিক্ষানবিশী জীবন চলতেই থাকে জীবনভর। আমরা প্রতিদিন শিখি। জীবনের রোজনামচা আমাদের প্রায় প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় কত কিছু যে শিখতে বা শিখে নিতে বাধ্য করে তার ইয়ত্তা নেই। আমরা ঠেকে শিখি, ঠকে শিখি, ভুল করি বিস্তর, আবারও ঠিক করে ফেলি। পরবর্তীতে অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনে ছাত্রাবস্থায় শেখা অনেক ভালো জিনিস কাজে লাগে। অনেক কিছু কিন্তু আবার লাগেও না। আমাদের ছাত্রাবস্থায় শেখা বিষয়গুলো সবসময় ঠিক ছিল কিন্তু নানা প্রতিকূলতা ও চাপের কাছে হয়তো সে আদর্শের কাছে অনেক সময় নতি স্বীকার করতে হয়। দেয়ালে কখনও পিঠ ঠেকে গেলে এও মনে হয়েছে, ধ্যাৎ জীবনে কিছুই শেখা হলো না আজও।
নার্সারি বা স্কুলে ভর্তি জীবনের আগে পর্যন্ত তো আমরা বাড়িতেই অ আ ক খ বা ইংরাজি বর্ণমালা, ১ থেকে ১০০, ছড়া, রং চেনা, পশুপাখিদের ছবি দেখে চিনতে শেখা, হাদিস, কোরআন ও নানা গল্প আরও কত কি বাড়িতেই শিখে যাই। এগুলো শিখি পারিবারিক পরিবেশে এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকেই। হামাগুড়ি বয়স থেকেই হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা সবই তাদের কাছেই। এক্কেবারে কচি বয়স থেকে আমাদের শিক্ষার হাতেখড়ি তাদের হাত ধরেই। আমাদের বাবা ও মা-ই আমাদের প্রথম ও পরম গুরু, জীবনযাপনের অন্যতম শিক্ষক। পরবর্তীতেও প্রিয় শিক্ষক তারাই। তাদের স্নেহে, প্রশ্রয়ে, শিক্ষায়, সহমর্মিতায়, মরমি সমালোচনায়, চরিত্র গঠনের দৃঢ় শিক্ষায় আমরা ঋদ্ধ হতে থাকি ক্রমশ। আমাদের প্রতিটি আচরণের বহির্প্রকাশ ঠিক কী হবে, শিশুবয়স থেকেই উচিত-অনুচিতের বোধ আমরা শিখতে থাকি তাদের কাছেই। আমাদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, আমাদের দায়বদ্ধতা বিশ্বাস, অন্যকে মান্যতা দেওয়া, গুরুজনকে সম্মান জানানো, নিজেদের পারিবারিক রীতিকে মর্যাদা দেওয়া, রক্ষণশীলতাকে টিকিয়ে রাখা এই সমস্ত কিছুই শিখি বাড়ির গুরুজন অভিভাবকদের থেকেই। আমাদের আদর্শ আমাদের চরিত্র গঠন সব কিছুর প্রাপ্তি তাদের থেকেই। শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে বাবা-মাকেই অন্যতম প্রারম্ভিক শিক্ষক তথা গুরু হিসেবে স্মরণ করে প্রণতি জানাই।
ফিরে আসি 'বিশ্ব শিক্ষক' দিবসে আমার প্রিয় শিক্ষকদের কথায়। বলা হয়ে থাকে-
'অ মৎবধঃ :বধপযবৎ রং ষরশব ধ পধহফষব্ত রঃ পড়হংঁসবং রঃংবষভ :ড় ষরমযঃ :যব ধিু ভড়ৎ ড়ঃযবৎং.'। আমার শিক্ষকরা সকলেই ছিল আমার অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধার। আমার জীবনে বেশিরভাগ শিক্ষকই ইতোমধ্যে গত হয়েছেন। শ্রদ্ধা জানাই তাদের। আমার শিক্ষকদের পেয়েছি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। তারা সকলেই নিঃস্বার্থভাবে আলো ছড়িয়েছেন। তারাই আমার মতো অনেকেরই আদর্শ। হয়তো অনেকের নাম এ মুহূর্তে স্মরণ হচ্ছে না। তবু সবাইকে স্মরণ করছি কৃতজ্ঞতা চিত্তে।
আমার শিক্ষকদের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুষ্পলতা ঘোষ (দিদিমনি), মোশাররফ স্যার, তদবির স্যার, নুরুল ইসলাম স্যার, মৌলভী স্যার (সকলেই প্রয়াত)। মাধ্যমিক পর্যায়ের অগাস্টিন হালসানা স্যার, আরজ আলী স্যার, সদর আলী স্যার, কবির উদ্দিন স্যার, নাহার স্যার, আনিস স্যার, আশুতোষ স্যার, হোসেন আলী স্যার প্রমুখ উলেস্নখযোগ্য। ইনারা সকলেই ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন। রাজ্জাক স্যার সম্ভবত এখনো আছেন। কলেজ জীবনের ফাদার পিশাতো, মন্জুরুল হক স্যার, বেনজীর স্যার, আব্দুল হামিদ স্যার, গরীব-এ-নেওয়াজ স্যার, আবুল হোসেন স্যার, অজিত স্যার, টিকে দত্ত স্যার, কে.সি. আচার্য স্যার-এদের কথা মনে পড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রব্বানী স্যার, হারুন অর রশীদ স্যার, কাইয়ুম ঠাকুর স্যার, মুহতেসাম হোসেন স্যার, ললিত কুমার নাথ স্যার, শামসুল ইসলাম স্যার, কামরুন নাহার আপা, মেজবাহ স্যার, মঈন স্যার, আয়েশা আপা, প্রফেসর এন কে চক্রবর্তি, ইউসুফ হায়দার স্যার- এদেরকে স্মরণ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের অনেকে এখনো ভালো আছেন এবং কর্মঠ আছেন। দেশের বাইরে প্রফেসর শ্রীভাস্তাভা, ভৌমিক স্যার, প্রফেসর জেডি সিং, প্রফেসর জেপি সিং, প্রফেসর শ্রী নিবাসন, প্রফেসর জে ডি সিং, প্রফেসর কুচ্চাল প্রমুখ উলেস্নখযোগ্য।
আমরা বার বার পেছন ফিরি। শিক্ষক দিবস নিয়ে লিখতে বসে ধুলো ঝাড়পোচ করে পেছনে ফিরে তাকানোর মতো। কখনও পুরনো স্মৃতিকাতরতা উথলে উঠে। ফেলে আসা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের জন্য মন কেমন করে। আবারও এই লেখার হাত ধরেই ফিরে দেখা। শিক্ষকদের নতুন করে দেখা। একাকী হাঁটতে হাঁটতে অথবা কল্পনায় কখনো দেখা হয় এদের সঙ্গে। হারিয়ে যাই। আনন্দ-বেদনায় মন কেমন করে, কষ্টটা টের পাই। জাপানের একটা প্রচলিত প্রবাদ হল- 'ইবঃঃবৎ :যধহ ধ :যড়ঁংধহফ ফধুং ড়ভ ফরষষরমবহঃ ংঃঁফু রং ড়হব ফধু রিঃয ধ মৎবধঃ :বধপযবৎ'। আমার শিক্ষকদের সকলেরই সাহচর্যে এরকম মনে হতো।
শিক্ষককে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতায় আমাদের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষ করে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছে না। ফলে দক্ষ কর্মীর অভাবে বিদেশিরা আমাদের দেশে এসে কাজ করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। একটা দেশের এগিয়ে যাওয়ার মূল হলো সে দেশের আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষককে অপমান করে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারেনি, পারবেও না। নীতি ও আদর্শের শিক্ষকতার সঙ্গে কখনো আপস করা উচিত নয়। সুস্থ শিক্ষার অর্থই হলো নীতিনৈতিকতা, সততা, মূল্যবোধসম্পন্ন ও দক্ষ জাতি গঠন।
এ কথা বহুলাংশে সত্যি যে শিক্ষকতা এমনই এক পেশা যাকে একসময় বলা হতো সব পেশার চেয়ে অন্যতম। তবে দিনকাল বদলেছে। অতীতের গুরুকুলে শিক্ষা, ব্রহ্মচর্য পালন এসব বহু পুরাতন অতীত। সেই সুচারু শিক্ষাব্যবস্থার এখন প্রচন্ড অবনতি হতে দেখছি শুনছি। কত মান পড়ে যাচ্ছে! যন্ত্রণা কাতর চোখে তা দেখি! এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দরকার।
\হঅন্তত জাতি তাই আশা করে। অকুণ্ঠচিত্তে শ্রদ্ধা জানাই পৃথিবীর সকল শিক্ষককে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের কাছে একটি মহান দিনপঞ্জি হয়ে থাকুক চিরকাল- এই প্রত্যাশা।
মো. রফিকুজ্জামান :সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও রেজিস্ট্রার, বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয় অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা