বৈষম্যহীন বাংলাদেশই কাম্য
রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে জনসেবা। জনকল্যাণে রাষ্ট্র সর্বদা ব্যাপৃত। আর এই জনকল্যাণে নিবিষ্ট কল্যাণমূলক রাষ্ট্রসমূহ সব ধর্মের বিষয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।
প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
অমল বড়ুয়া
নাগরিক জীবনের সর্বোচ্চ ও শক্তিশালী রাজনৈতিক একক সংগঠন হচ্ছে রাষ্ট্র, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্র সাধারণত একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বসবাসকারী সমাজের সদস্যদের শাসনের জন্য আইন-কানুন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। রাষ্ট্রের সব নাগরিক নির্বিশেষে সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে। রাষ্ট্র ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচার-আচরণের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের সঙ্গে বৈষম্য করে না এবং কেউ করলে তার প্রতিরোধে কাজ করে। কারণ, রাষ্ট্র হচ্ছে রাষ্ট্রস্থিত সব নাগরিকের একক ও অদ্বিতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তাই রাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোনো এক ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। রাষ্ট্রের মধ্যে বহু ধর্ম-সম্প্রদায় মিলেমিশে এক ও অভিন্ন হয়ে নাগরিক পদবাচ্য ধারণ করে। রাষ্ট্র নিজেই একটি ধর্ম। রাষ্ট্র নামক ধর্মের প্রতি আনুগত্য হচ্ছে দেশপ্রেম। এই রাষ্ট্র ধর্মের প্রধান গ্রন্থ হচ্ছে 'সংবিধান', প্রধান ধর্মযাজক হলেন রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রধর্মের প্রচারক হলেন রাষ্ট্রের নাগরিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, রাষ্ট্রধর্মের অনুসারী হলেন সব নাগরিক আর রাষ্ট্রধর্মের প্রতিপালিত বিধিবিধান হলো রাষ্ট্রীয় অনুশাসন। মোটকথা, রাষ্ট্র যেখানে নিজেই একটি ধর্ম, সেখানে আলাদা রাষ্ট্রধর্ম হতে পারে না।
রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে জনসেবা। জনকল্যাণে রাষ্ট্র সর্বদা ব্যাপৃত। আর এই জনকল্যাণে নিবিষ্ট কল্যাণমূলক রাষ্ট্রসমূহ সব ধর্মের বিষয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।
রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ কোম্পানির সরকারও ছিল খুবই কঠোর। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী অনুধাবন করেছিল যে, তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাষ্ট্রকে ধর্ম সম্পর্কে অবশ্যই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। ব্রিটিশ কোম্পানির কলকাতা ও লন্ডনস্থ সরকার নিশ্চিত হয়েছিল যে, রাষ্ট্র ধর্মের ব্যাপারে কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারলে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হতো। আঠারো শতকের শেষভাগে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের শুরুতে রাষ্ট্র ও ধর্ম এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত কোম্পানির কর্মকর্তারা হিন্দু-মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবেই যোগদান করতেন। কিন্তু কর্নওয়ালিসের প্রশাসন কোম্পানির কর্মকর্তাদের এসব অনুষ্ঠানে যোগদান নিষিদ্ধ করেন। কারণ এসব অনুষ্ঠান ছিল কোম্পানির কর্মকর্তাদের দুর্নীতির উৎস কেননা আমন্ত্রণকারীদের কাছ থেকে তারা উপহার হিসেবে নগদ অর্থ বা দ্রব্যসামগ্রী গ্রহণ করতেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের জন্য ভারতের দ্বার উন্মুক্ত রাখার ব্যাপারে লন্ডন থেকে ক্রমবর্ধমান চাপ সত্ত্বেও কোম্পানি কখনই খ্রিস্টধর্ম মিশনারিদের কাছে নতি স্বীকার করেনি। কোম্পানির এলাকায় মিশনারিদের গতিবিধির প্রতি সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখা হতো এবং ধর্মপ্রচারের কাজে তারা কোনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লাভ করত না।
পিউ রিসার্চের রিপোর্টে বলা হয়েছে- 'বেশকিছু ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক নিয়মনীতি থাকে। কিন্তু আইনি বা কর-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা, রিয়েল এস্টেট বা সম্পত্তির মালিকানা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া দেখা যায়, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও ধর্মচর্চার বাধ্যবাধকতার কারণে সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ওপর বিধিনিষিধ আরোপ করা হয় বা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।' তাই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্র হতে পারে না। প্রথমত ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও সুশাসন কার্যকরকরণে ধর্মীয় বিবিধ আইন-কানুন, বিধিনিষেধ, ধর্মীয় রীতি ও প্রথা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে পরিষ্কার বিভাজন রেখা টেনে দিয়ে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে উস্কে দেয়। এতে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর নিপীড়নের (ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা উপভোগের ক্ষেত্রে) শিকার হয়ে এক প্রকার অস্বস্তিকর ও অনিরাপদ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতন, বিতাড়ন ও বঞ্চনার শিকার হয়। রাষ্ট্র যদি কোনো একক ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয় না দেয় তাহলে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্রতা ছড়াতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রিক প্রভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ যথাযথ মানবাধিকার উপভোগ করতে পারে না। সম্পদের সুষম বণ্টন, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, বাকস্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার লাভে বৈষম্যের শিকার হয়। কর্মক্ষেত্রে নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়। ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ধর্মান্তরকরণ, সম্পদ দখল এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার মতো ঘটনাও ঘটে। আবার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় নেতাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্ম নিয়ে কটূক্তি ও উসকানি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করে দেয়। তাছাড়া বিবিধ আইন (বস্ন্যাসফেমী আইন) দ্বারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষিত হয়, কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার ক্ষুণ্ন্ন হলেও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সংখ্যালঘুর ওপর খঁড়গ হস্ত হয়। এর ফলে সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তৃতীয়ত, ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে সবসময় ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের প্রাধান্য থাকায় সংখ্যালঘুরা সম-অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। শক্ত প্রতিনিধিত্বের অভাবে তারা অবহেলিত ও উপেক্ষিত থেকে যায়। এতে তাদের সর্বাঙ্গীন অগ্রগতি প্রগতি ও উন্নতি ব্যাহত হয়। রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের কারণে স্বধর্ম ও আত্মরক্ষার অজুহাতে দেশত্যাগে বাধ্য হয়। চতুর্থত, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে সংখ্যালঘুদের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, নিরাপত্তাহীনতা ও হীনম্মন্যতা দেখা দেয়। এর ইতিহাস যতই দীর্ঘ হয় ততই তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ ক্রমে দুর্বল ও ফিকে হতে থাকে। তারা নিজেদের ছিন্নমূল মনে করতে থাকে। ফলে রাষ্ট্রীয় একতা, প্রগতি ও উন্নতি রুদ্ধ হয়। বিভক্তি বাড়ে। এর সঙ্গে বিপস্নব-বিদ্রোহ, গেরিলা ও সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে মূলত আত্মরক্ষাবোধের কারণে। পঞ্চমত, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ধর্ম অনেক সময় দেশের অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্মীয় মতবাদ, কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিধানকে চাপিয়ে দেওয়ার কারণে। এক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য হলো আফগানিস্তান, মায়ানমার ও পাকিস্তান। পক্ষান্তরে বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত দেশ আমেরিকা, চীন, জাপান ও কানাডা রাষ্ট্রধর্ম নিরপেক্ষ হওয়ায় এই দেশগুলো অবিরাম এগিয়ে যাচ্ছে। ষষ্ঠত, রাষ্ট্রধর্ম থাকলে নাগরিকদের কেবল ধর্মীয় পরিচয়ে আলাদা করে দেখার প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে। এতে করে নিজ ধর্ম সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠতা তুলে ধরতে সংখ্যালঘুদের অধিকারে বিভেদের সুক্ষ্ন দেয়াল তুলে দেওয়া হয়। ধর্মকে রাষ্ট্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার দ্বারা অসহিষ্ণুতা বেড়ে যায়। আদিবাসী ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। সপ্তমত,
ধর্ম হচ্ছে খুবই ব্যক্তিক ও ব্যক্তি-সম্প্রদায়ের বিশ্বাস আচার-আচরণ ও মনের বিষয়। রাষ্ট্র সেই ব্যক্তি-সম্প্রদায়ের এককত্বের প্রতিনিধিত্ব করলে সামগ্রিক জাতীয় চেতনা, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ বিপন্ন হতে পারে। তাছাড়া রাষ্ট্রিক জন বৈচিত্র্য বিনষ্ট হতে পারে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদী জনসমাজব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়তে পারে। ধর্ম নিয়ে চাপাচাপি ও বাড়াবাড়িতে দেশে অস্থিতিশীলতা বিশেষ করে অন্যায়, অবিচার, অসাম্যতা ও অনৈক্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
তাই আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফিরে আসা উচিত। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কোনো একটি ধর্মের বিশেষ প্রভাব থাকে না। নাগরিকরা নিজেদের ধর্ম পালনে স্বাধীন থাকেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আইন ও নীতিমালা ব্যক্তির মতামত ও সার্বিক কল্যাণকে সামনে রেখে প্রণয়ন করা হয়। এক্ষেত্রে বিবেচিত হয়- 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার'। বিশ্বে এমন কতগুলো রাষ্ট্র আছে যেখানে কোনো একটি ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৯৫ শতাংশের বেশি থাকলেও রাষ্ট্র সেই ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। হন্ডুরাস, পানামায় ১০০ শতাংশ মানুষ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তুরস্ক, আজারবাইজান, গাম্বিয়া ও কসোভোয় মুসলমানদের সংখ্যা ৯৫ থেকে ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ। নেপালে হিন্দুদের সংখ্যা ৮১ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু এসব কোনো দেশেই কোনো ধর্ম একক রাষ্ট্রধর্ম নয়। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২-এর দ্বিতীয় অংশে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে পুনঃস্থাপিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বলা হয়েছে- সর্বপ্রকারের সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে কোনো বৈষম্য থাকে না। তাই বৈষম্যহীন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশই কাম্য।
অমল বড়ুয়া :প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট