বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

সুনাগরিক গঠনে রাষ্ট্রের ভূমিকা

দার্শনিক ম্যাক্স শেলার বলেন, মূল্যবোধ হলো 'বস্তুর অভ্যন্তরে থাকা গুণাবলি, যা আমাদের অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় এবং এটি মানুষকে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে প্রভাবিত করে।' নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা ছাড়া কোনো রাষ্ট্র কখনই সুনাগরিক গড়ে তুলতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের এই বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা অতীব জরুরি।
জসিম উদ্দিন
  ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
সুনাগরিক গঠনে রাষ্ট্রের ভূমিকা

একটি সুন্দর রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজন সে দেশের জনগোষ্ঠীকে সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য ২টি পদ্ধতি রয়েছে। ১. বুদ্ধিবৃত্তিক ও ২. রাষ্ট্রীয়ভাবে। তবে প্রথমটির থেকে দ্বিতীয়টির গুরুত্ব অধিক। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশ ভাগ করার মাধ্যমে যে স্বপ্ন এই উপমহাদেশের মানুষ দেখেছিল তা পাকিস্তানের ২৪ বছরের কুশাসনে আমরা লাভ করতে পারিনি। ফলে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং একটি শাসনতন্ত্র পেয়েছি। কিন্তু যে সুন্দর বৈষম্যহীন, আদর্শ রাষ্ট্র প্রয়োজন তা আমরা বিনির্মাণ করতে পারিনি। আজ দীর্ঘ ৫০ বছর হলো আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা সুন্দর একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ফলে জুলাই বিপস্নবের মাধ্যমে পুনরায় স্বৈরাচার সরকারের পতনের ফলে আমাদের স্বাধীনতা ২.০ অর্জন করতে হয়েছে। এই যে ৫০ বছরের ইতিহাসে বারবার আন্দোলন, বিপস্নবের মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হচ্ছে, এর একটা সুন্দর সমাধান আমাদের চাই। আর এই সুন্দর সমাধানের জন্য প্রয়োজন সচেতন এবং সাহসী সুনাগরিক। একটি দেশের উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন সে দেশের জনগণ সুনাগরিক হয়। আসলে এই সুনাগরিক কারা? সুনাগরিকের সংজ্ঞাই বা কি? আসুন আলোচনা করি। সু শব্দের অর্থ হলো ভালো বা আদর্শ। তাহলে সুনাগরিক মানে হলো আদর্শ নাগরিক। অধ্যাপক ই. এম. হোয়াইটের মতে 'সাধারণ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠা- এ তিনটি গুণ যদি কোনো নাগরিকের থাকে তাহলে সে-ই সুনাগরিক।' বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বক্তব্যে নাগরিকের অনেকগুলো গুণের উলেস্নখ রয়েছে। তবে লর্ড ব্রাইস প্রদত্ত উপাদানগুলোই এ পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। তিনি মনে করেন কোনো নাগরিক সুনাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবে যদি তিনটি গুণ; যথা- ১) বুদ্ধি, ২) আত্মসংযম ও ৩) বিবেক থাকে। আর এর সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্র সম্পর্কেও যথেষ্ট স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র। বিভিন্ন লেখক ও চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, 'পরিপূর্ণ ও স্বনির্ভর জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে কতিপয় পরিবার ও গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনই রাষ্ট্র।' প্রাচীন চিন্তাবিদদের রাষ্ট্রসংক্রান্ত আলোচনা মূলত আদর্শভিক্তিক ও নগর রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। রাষ্ট্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায় অধ্যাপক গার্নারের প্রদত্ত সংজ্ঞা থেকে। তার মতে 'রাষ্ট্র হলো কম বা বেশি এমন একটি জনসমাজ, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাইরের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যাদের একটি সুসংগঠিত সরকার আছে যার প্রতি অধিকাংশ অধিবাসীই সাধারণত আনুগত্য পোষণ করে।' তাহলে চলুন, জেনে নেই সুনাগরিক গঠনে রাষ্ট্রের ভূমিকা আসলে কি! রাষ্ট্র কীভাবে সুনাগরিক তৈরি করতে পারে তা আমরা নিচে আলোচনা করব। ১. সুনাগরিক নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া : রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিয়ে জনগণের মাঝে রাষ্ট্র এবং সুনাগরিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক সভা, সেমিনার, ব্যানার ফেস্টুন ইত্যাদির মাধ্যমে নাগরিক ও সুনাগরিক বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ২. মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা : সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ৩টি স্তর বিদ্যমান।০ প্রাথমিক ১-৫, মাধ্যমিক ৬-১০, উচ্চ মাধ্যমিক ১১-১২ পর্যন্ত। এবং এর পরের ধাপ টার্শিয়ারি লেভেল অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে এই স্তরের পরিবর্তন হয় এবং বিভিন্ন ধরনের হাইপোথেসিস প্রয়োগ করা হয়। যার ফলে পূর্বের বিদ্যমান যেসব শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল তাও ভেঙে পড়ে। অথচ সুনাগরিক গঠনে মানসম্মত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নেই। আমাদের তরুণরা দীর্ঘ ১২ বছর তাদের শিক্ষাজীবনে এই স্তরগুলো অতিবাহিত করে। ফলে মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া সুনাগরিক হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ৩. নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা : বিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষা প্রদান করতে হবে। একজন মানুষের কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয় তা নির্ভর করে তার বুদ্ধিমত্তার ওপর। সে যদি নৈতিকতাশূন্য হয় তাহলে তার পক্ষে নৈতিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। আসলে এই নৈতিকতা কি? নৈতিকতা (ঊঃযরপং) হলো এমন একটি শাস্ত্র বা দর্শন, যা মানুষের আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার বিচার-বিশ্লেষণ করে। এটি ভালো ও খারাপ, সঠিক ও ভুল কাজের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে এবং কীভাবে মানুষকে সমাজে আচরণ করতে হবে তা নির্ধারণ করে। এরিস্টটল নৈতিকতার ওপর ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'ঘরপড়সধপযবধহ ঊঃযরপং'-বইয়ে বলেন, নৈতিকতা হচ্ছে মানুষের সুখ ও কল্যাণের জন্য সঠিক আচরণ বেছে নেওয়া এবং তা চর্চা করা। অন্যদিকে, ইমানুয়েল কান্ট (ওসসধহঁবষ কধহঃ) নৈতিকতার ক্ষেত্রে তার বিখ্যাত তত্ত্ব 'ঈধঃবমড়ৎরপধষ ওসঢ়বৎধঃরাব' প্রদান করেন। তার মতে, নৈতিকতা হলো এমন একটি নীতি বা আদর্শ, যা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার বাইরে গিয়ে সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য। অন্যদিকে সুনাগরিক গঠনে মূল্যবোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে

দার্শনিক ম্যাক্স শেলার বলেন, মূল্যবোধ হলো 'বস্তুর অভ্যন্তরে থাকা গুণাবলি, যা আমাদের অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় এবং এটি মানুষকে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে প্রভাবিত করে।' নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা ছাড়া কোনো রাষ্ট্র কখনই সুনাগরিক গড়ে তুলতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের এই বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা অতীব জরুরি।

\হ৪. সাম্প্র্রদায়িক সহমর্মিতা তৈরি : সামাজিক ও ধর্মীয় সহমর্মিতা শিক্ষা প্রদান। আমরা জানি একটি জাতি যদি তার প্রতিবেশীর প্রতি সহমর্মিতা না থাকে তবে একত্রে বসবাস করা সম্ভব নয়। এর জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই তাহলে দেখতে পাব আমাদের এ অঞ্চলের প্রাচীনকাল থেকেই সহমর্মিতার একটি ছাপ রয়েছে। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলেও আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। যার ফলে আমাদের উপমহাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ সব ধর্ম, সম্প্র্রদায় এবং জাতি একত্রে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে যখন তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে 'ভাগ কর শাসন কর' নীতির প্রয়োগ শুরু করল তখন থেকেই বিভেদ শুরু হলো। দেখা গেল ১৯৪৭-এ দেশভাগের পূর্বে সাম্প্র্রদায়িক সহমর্মিতা নষ্ট হয়ে যায়। প্রধান ২টি সম্প্র্রদায় জড়িয়ে পড়ে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গায়। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ১৯৪৬-এর গুজরাট, নোয়াখালী এবং উড়িষ্যার দাঙ্গা। যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সব সাম্প্র্রদায়িক 'ভাগ কর শাসন কর' নীতি না হতো তাহলে হয়তো এমন ক্ষতি হতো না। সুতরাং সুনাগরিক গঠনে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো সাম্প্র্রদায়িক সহমর্মিতা সৃষ্টি করা। ৫. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : সুনাগরিক গঠনে আইনশৃঙ্খলার গুরুত্ব সম্পর্কে বিখ্যাত দার্শনিক থমাস হবস (ঞযড়সধং ঐড়ননবং) বলেছেন, 'আইন ও শৃঙ্খলা ছাড়া সমাজ অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হয়।' তার মতে, মানুষের স্বার্থপর প্রকৃতি ও আত্মরক্ষার প্রবণতা তাদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও আইনব্যবস্থার প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকলে সমাজে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন সম্ভব হয় এবং নাগরিকরা নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে পারে। এর ফলে মানুষ নৈতিক ও আদর্শিকভাবে উন্নত হয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। তার এই ধারণা তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'খবারধঃযধহ' (১৬৫১)-এ সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং বোঝা যায়, সুনাগরিক গঠনে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা।

৬. মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা : এলেনর রুজভেল্টের ১৯৫৮ সালে জাতিসংঘে দেওয়া একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'মানবাধিকার শুরু হয় ছোট ছোট স্থানে, ঘরে এবং কমিউনিটিতে, যেখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ সুরক্ষিত হয়।' মানবাধিকার সুনাগরিক গঠনে সহায়ক, কারণ এটি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে ন্যায়বিচার, সমতা ও স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করে। সুতরাং সুনাগরিক গঠনে রাষ্ট্রের মানবাধিকার সুরক্ষা করা অতীব জরুরি।

৭. শৃঙ্খলা ও ন্যায়পরায়ণতা : রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো যদি সুশৃঙ্খল হয় এবং রাষ্ট্রে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহলে তা সুনাগরিক গঠনে সহায়তা প্রদান করে। আমাদের সমাজের সব বিষয়ে তাই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে শৃঙ্খলা ও ন্যায়পরায়ণতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৮. আদর্শ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা : স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির মাধ্যমে সচেতন নাগরিক গঠন সম্ভব। একটি প্রবাদ আছে, 'সুস্থ দেহ সুন্দর মন।' একটি সমাজ কতটা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ তার ওপর নির্ভর করে তার অগ্রগতি। এ জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সমাজের সর্বনিম্ন্ন স্তর থেকেই স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ৯. অসাম্য দূরীকরণ : সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রয়োজন। সাধারণত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে ২টি শ্রেণি দেখা যায়। এদের মধ্যে যাদের অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা ইত্যাদি থাকে তাদের এসব দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে আবার যাদের সমাজে এসব কম থাকে তারা দিন দিন আরও নিম্ন্নে চলে যায়। বর্তমান সমাজেও অঘোষিত এমন একটি শ্রেণিব্যবস্থা রয়েছে যেখানে দেখতে পাওয়া যায় যে, সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষের মধ্যে দেশের একটা বৃহৎ অর্থ, প্রভাব প্রতিপত্তি কুক্ষিগত থাকে এবং আর একটি শ্রেণির তেমন কিছুই থাকে না। তাদের জীবন চালানোই কষ্টকর। তাছাড়াও অধিক বেকারত্ব বিভিন্ন অনৈতিক কাজের মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে সমাজের সুনাগরিক গঠনের পথে বৃহৎ একটি অন্তরায়। রাষ্ট্রের উচিত এসব সমস্যা সমাধানের পথ নির্ধারণ করা। যদি সমাজের মধ্যে একটা সাম্যের শ্রেণি তৈরি হয় তাহলে তা সুনাগরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১০. জনসেবামূলক কার্যক্রম : একজন মানুষ যদি সমাজের ভালো কাজে অংশগ্রহণ করে তাহলে নাগরিক হিসেবে সে তার গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে পারবে। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা রয়েছে যেমন, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, গার্লস গাইড, রেড ক্রিসেন্ট ইত্যাদি এরকম আত্ম-উন্নয়ন সংস্থাগুলো সুনাগরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১১. নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি : কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও কর্মক্ষমতা বাড়ানো সুনাগরিক গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। কবি বলেন, 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়' অর্থাৎ যদি সমাজে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি স্থিতিশীল না রাখা যায় তাহলে সেই সমাজ সাহিত্যের মতোই হয়। যা বাস্তবতার বাইরে। আমাদের দেশে বিবিএস'র তথ্যমতে প্রায় ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। এবং প্রতি বছর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি কারো উদরে ভাত না থাকে তাকে নীতিকথা বলে লাভ নাই। সুতরাং আগে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে এবং সুনাগরিক গঠনের চেষ্টা করতে হবে। ১২. উদ্যোক্তা তৈরির প্রচেষ্টা : রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি থিউরি প্রচার করেন, যা থ্রি জিরো থিউরি হিসেবেই পরিচিত। যেমন ধ) ুবৎড় ঢ়ড়াবৎঃু, ন) ুবৎড় ঁহবসঢ়ষড়ুসবহঃ ধহফ প) ুবৎড় পধৎনড়হ বসরংংরড়হ. এবং তিনি যুবসমাজকে উদ্যোগক্তা হওয়ার আহ্বান করেন। ১৩. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত : ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিয়মতান্ত্রিক ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার রক্ষার, নাগরিক আইন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুনাগরিক গঠন করা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুনাগরিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতন্ত্রের মূলনীতি যেমন সমতাভিত্তিকতা, অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা এবং সম্মানবোধ গড়ে তোলে। ড. আতিউর রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নাগরিকদের সক্ষম করে তোলে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে এবং সামাজিক বিচার নিয়ে ভাবতে। এই মূল্যবোধ নাগরিকদের সচেতন করে তোলে। ফলে তারা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে এবং সমাজের উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাই সুনাগরিক গঠনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অপরিহার্য। ১৪. অধিকার ও দায়িত্বের সম্পর্ক : নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এবং দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। একজন নাগরিক যদি আইনের কোন ধারায় তার কি কি অধিকার আছে, কি কি অধিকার নাই বা তার দায়িত্ব কি সে বিষয়ে না জানে তাহলে তার পক্ষে সুনাগরিক হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সংবিধানে ৩য় অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা আছে, অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের রক্ষা কবজ। আমাদের ফৌজদারি আইনে নিজের অধিকার সংবলিত বিভিন্ন ধারা যেমন অনৈতিক কাজ করলে শাস্তি, বিনা ওয়ারেন্ট এ অ্যারেস্ট করতে না পারা, ব্যক্তিগত কাজে হস্তক্ষেপ না করা ইত্যাদি অধিকার সম্পর্কে জানলে একজন সুনাগরিক হতে পারে। ১৫. দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা ও সংরক্ষণ : রাষ্ট্রের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক চর্চা এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতি একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। ঐক্যবদ্ধ জাতি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে সহজেই বের হয়ে আসতে পারে। সুস্থ, শালীন এবং নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে এমন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সুনাগরিক হতে পারে। এজন্য রাষ্ট্র কর্তৃক তার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ১৬. ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে রাষ্ট্রের অবদান অনস্বীকার্য। একবিংশ শতাব্দী তথ্য প্রযুক্তির শতাব্দী। বর্তমান জেনারেশন যে জাতি যত বেশি আইটিতে উন্নতি করছে তারাই এগিয়ে রয়েছে। যুবসমাজকে আইটির সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে আউটসোর্সিং-এর মতো মুক্ত পেশায় যুক্ত করে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করা সম্ভব। এবং তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করাও সহজ। তাই নাগরিককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে। যদি রাষ্ট্র এই কাজ করতে পারে তবেই সুনাগরিক গঠন করা সক্ষম।

১৭. গণমাধ্যমের ভূমিকা : গণমাধ্যমের অবাধ বিচরণ ক্ষমতা দিতে হবে। একটি দেশে কি হচ্ছে, কি হওয়া উচিত, কেন হওয়া উচিত- এমন অনেক তথ্য, পরামর্শ আমরা গণমাধ্যম থেকে পেতে পারি। এই গণমাধ্যম আমাদের সুনাগরিক হতে সাহায্য করতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার মাধ্যমে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

উপরোক্ত বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করলেই আমাদের দেশে সুনাগরিক গঠন করা সম্ভব। আমরা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখি যা আমাদের উন্নত বিশ্বের সঙ্গে একসঙ্গে চলতে সাহায্য করবে। আমাদের বহির্বিশ্বে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দিবে। সুতরাং এর জন্য রাষ্ট্রে সুনাগরিক থাকা অতীব জরুরি। এবং এর জন্য রাষ্ট্রকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

জসিম উদ্দিন :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে