সারাদেশে অতি গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। একপশলা বৃষ্টির জন্য চতুর্দিকে হাহাকার। এ যেন এক জ্বলন্ত মরুভূমি। মানুষ তার দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে হিমশিম খাচ্ছে এই ভ্যাপসা গরমে। হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা নিয়েই হাটে-মাঠে কাজ করছেন সাধারণ মানুষরা। শরতের এই সময় তাপমাত্রা কমার কথা; কিন্তু ঘটছে এর উল্টো। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ যেন শীতকাল আর গ্রীষ্মকাল নামে দুটি ঋতুতে পরিণত হয়েছে। শীতকালে অতি শৈত্য বা কম শৈত্য পড়া, গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা এখনকার নিত্য ঘটনা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল নেত্রকোনায় ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর সিলেটে উঠেছিল ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাধীনতার পর ওই দুই জেলায় সেপ্টেম্বর মাসে এত বেশি তাপমাত্রা ওঠেনি। রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে ২৩ সেপ্টেম্বরও দেশের ৪০ জেলায় তাপপ্রবাহ ছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু-বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (থ্রিসিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ সেপ্টেম্বর। তবে চলতি বছরের শুরুতে নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, জলবায়ুর প্যাটার্ন এল নিনো আবারও ফিরে আসায় ২০২৪ সাল বিগত বছরের চেয়েও বেশি উষ্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন ঘটছে? এর উত্তরটাও আমাদের সবারই জানা, আমরাই পরিবেশের এই বিরূপ আচরণের জন্য দায়ী। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি উজাড়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট এবং কলকারখানা তৈরিতে অধিক জমি ব্যবহার করে বনভূমি ধ্বংসের ফলে বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মাটি এবং পানি দূষিত হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন এবং কলকারখানায় পণ্য তৈরি হয়। মানুষ যাতায়াতের জন্য যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। কলকারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ক্ষতিকর গ্যাস বায়ু দূষিত করছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশ তার স্বাভাবিক ভারসাম্য হারাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সুস্থ, সুন্দর ও বাসযোগ্য ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য যেকোনো দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। তবে সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে মোট বনবিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর; যা দেশের আয়তনের শতকরা ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ।
গত মার্চ মাসে ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট সাসটেইনেবিলিটি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা মতে, জলাভূমি ও গাছপালা কমে যাওয়া, দ্রম্নত নগরায়ণের কারণে ঢাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যেসব এলাকার জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে, সেখানে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি। আর যেসব এলাকায় জলাভূমি টিকে আছে, সেখানে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা তিন দশকে (১৯৯০-২০২০) সর্বোচ্চ গড়ে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়েছে। তিন দশকে ঢাকার জলাভূমি কমেছে ৬৯ শতাংশ। জলাভূমি কমে যাওয়ার প্রবণতা এখনকার মতো চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এর ৯০ শতাংশই উধাও হয়ে যাবে। এতে এই নগরীর তাপমাত্রা আরও বাড়বে। তিন দশকে ঢাকার ৬৯ শতাংশ জলাভূমি কমে গেছে। জলাভূমি সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে। বর্তমান প্রবণতায় ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকার জলাভূমি ৭৪-৯০ শতাংশ কমে যেতে পারে। যদি সংরক্ষণ করা হয়, তবে এর পরিমাণ হতে পারে ৬৬ শতাংশ। দেখা গেছে, তিন দশকে ভরাট হয়ে যাওয়া এলাকার তাপ বেড়েছে ৩-৯ দশমিক ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য এলাকায় এর পরিমাণ গড়ে বছরে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যার কারণে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা একটি তাপীয় দ্বীপে পরিণত হচ্ছে। এর প্রতিকারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখনি জরুরি। তাপ কমাতে সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে হবে। গাছ লাগানোর পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু চারা রোপণ নয়, এগুলোর লালনও করতে হবে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের দখল হয়ে যাওয়া জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সারাদেশে আগামী ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন জাতীয় সব ধরনের ব্যাগ নিষিদ্ধ এবং কোনো ক্রেতাকে এই ব্যাগ দেওয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্রেতাদের জন্য পলিথিনের বিকল্প হিসেবে প্রতিটি সুপারশপ বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখতে বলা হয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, এর বাস্তবায়ন করতে হবে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থার মাধ্যমে বৃক্ষরোপণের উপকারিতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে পবিবেশ রক্ষায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব।
জয়নুল হক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়