বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

স্বাস্থ্য খাত : চারদিকে সিন্ডিকেট

একদম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এই সিন্ডিকেট শুরু হলেও হাসপাতালের সামান্য কর্মচারীটাও বাদ যায় না সিন্ডিকেট থেকে।
আজহার মাহমুদ
  ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
স্বাস্থ্য খাত : চারদিকে সিন্ডিকেট

বাংলাদেশের ইতিহাসে সিন্ডিকেট একটা পুরনো সংকট। এটি ১৯৭২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে ও বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শাসন থেকে শুরু করে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা কারও আমলে এই সিন্ডিকেট বাণিজ্য নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তর্কসাপেক্ষে কোনো সরকারের আমলে কম, কোনো আমলে বেশি। তবে বিগত ১৫ বছর সিন্ডিকেটের সেই বটগাছের মূল এত বড় হয়েছে যে, এখন চাইলেও সেসব সিন্ডিকেট ভাঙা সহজ নয়।

ভাবছেন এত কঠিন কেন! সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজে এমন অনেক ঘটনা আমরা চিত্রনাট্যের মাধ্যমে দেখতে পাই। একদম হুবহু একই না হলেও আদতে পর্দার এসব ঘটনার মতোই বাস্তবে এই দেশে সিন্ডিকেট বাণিজ্য চলছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সিন্ডিকেট বাণিজ্য যেখানে আমরা ভাঙতে পারছি না কেন সেই আলাপ করছি সেখানে ৫০ টাকার সিন্ডিকেট বাণিজ্যও আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। বিষয়টা হয়তো পাঠকরা এখনো পরিষ্কার বুঝতে পারছেন না। আরেকটু পরিষ্কার করা যাক-

আমাদের দেশে কোনখানে সিন্ডিকেট নেই- সেটা বের করা মুশকিল। প্রায় সব ধরনের খাতেই ঘুষ, দুর্নীতির সিন্ডিকেট আছে। সেটা অনেকটা প্রকাশ্যেই। ঠিক তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্যের কত বড় বিপর্যয় গত ১৫ বছরে হয়েছে সেই ইতিহাসে আপাতত না যাই। ওষুধ বাণিজ্যে সিন্ডিকেট, ডাক্তারদের সিন্ডিকেট, হাসপাতালের সিন্ডিকেট, ডায়গানিস্টক সেন্টারের সিন্ডিকেট এসব আমাদের অজানা নয়। কিন্তু এসব সিন্ডিকেটের এখন ধাপ বাড়তে বাড়তে সেটা ৫০/১০০ টাকার সিন্ডিকেটেও চলে এসেছে। মানে এই সিন্ডিকেট একদম ওপর তলা থেকে শুরু করে নিচ তলায়ও এসে ঠেকেছে।

আমি আরেকটু পরিষ্কার করি। একটি সরকারি হাসপাতালে রোগী নিয়ে গেলেন চিকিৎসার জন্য। রোগীর জন্য হুইল চেয়ার লাগবে। হাসপাতালে তখন সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার পাবেন না, কিন্তু ৫০/১০০ টাকা দিলে ২/৩ জন কর্মচারী চেয়ার নিয়ে হাজির। বেড পাবেন না, ফ্লোরে থাকতে হবে। ১০০/২০০ টাকা দিলে আবার ৩/৪টা বেড খালি হয়ে যায়। কেবিন পাবেন এমনিতে, ২/৩শ টাকা দিলে কেবিনের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। একটা হাসপাতালের সিন্ডিকেট কতটা স্ট্রং হলে এসব কাজ দিনের পর দিন হতে থাকে।

এই যে ৫০/১০০ টাকার সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না, সেখানে হাজার হাজার টাকার সিন্ডিকেট ভাঙবেন কীভাবে! সেটা দিবাস্বপ্ন হয়ে যায়। হাসপাতালের ডাক্তাররা দালালদের টাকার লোভে যুক্ত হয় ওষুধ বাণিজ্যে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ওষুধ লিখছে। কিছু কিছু ডাক্তার আজকাল ওষুধের দোকান থেকেও কমিশন খাওয়া শুরু করেছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাব এসব রেফার করার পাশাপাশি ওষুধের দোকানও রেফার করে থাকেন। আর ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন উপহার পাওয়ার গল্প তো আমরা সবাই জানি।

এতেই শেষ নয়। এসব তো মাত্র নিচ তলার গল্প। ওপর তলায় আরও ভয়ংকর গল্প অপেক্ষা করছে। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ পাওয়া সোনার হরিণ। সেটাও মেলে টাকা দিলে। আওয়ামী লীগের আমলে আবার কিছু কিছু নেতার ফোনেও মিলতো সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ। এই আমলে বোধ হয় সেটাও পাওয়া যাবে না। ১০ জনের মধ্যে ৯ জনকেই টাকা দিয়ে আইসিইউ ম্যানেজ করতে হবে। জানি না, বর্তমান সরকার এ বিষয়ে কতটা পদক্ষেপ নেয়। সত্যি বলতে এত এত সমস্যার মাঝে এসব সমস্যার দিকে নজর দিতে না পারাটা দোষের কিছুও নয়।

সরকারি হাসপাতালে যেমন আইসিইউ পাওয়া দুষ্কর, তেমনি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ আপনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আপনি মরার পরেও এসব হাসপাতালের আইসিইউ আপনাকে কয়েকদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আইসিইউ থেকে আপনার লাশ বের করার আগে অবশ্য সম্পূর্ণ পেমেন্ট দিতে হবে। না হয় লাশ আটকে থাকবে। এসব গল্প আমরা নিশ্চয়ই আগেও শুনেছি।

আমরা যতটুকু দেখি ততটুকুই জানি। কিন্তু অনেক কিছু দেখাও যায় না, জানাও যায় না। তবে বুঝা যায়। আমাদের ওষুধ বাণিজ্য এতটাই মারাত্মক সিন্ডিকেটে ভরে গেছে এখন ড্রাগ লাইসেন্স পাওয়া যায় টাকা দিয়ে। আবার হাজার হাজার দোকান ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াই আমাদের চারপাশে করছে রমরমা ব্যবসা। এসব কি দেখার কেউ নেই? অবশ্যই আছে। তারা দেখছেনও। দেখে দেখে মোটা অংকের অর্থও হাতাচ্ছেন। আপনি ভাবছেন মোটা অংকের এসব টাকা তারা কীভাবে দিচ্ছে? এই ব্যবসায় এতটাই লাভ! হঁ্যা, আপনার আমার গলা কাটতে পারলে এই ব্যবসা আসলেই লাভ। আর আমাদের জনগণের পকেটের টাকা দিয়ে এই ব্যবসা লাভজনক করে তুলছে সবাই। দোকানদার আমার টাকা নিয়ে প্রশাসনকে দিচ্ছে। মাঝখানে সবাই আমাদেরই মারছে। আমরা ভেজাল, মেয়াদহীন ওষুধও কিনে খাচ্ছি। যেখানে নজরদারি নেই কিংবা লোক দেখানো নজরদারি সেখানে অপরাধ সংঘটিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

একদম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এই সিন্ডিকেট শুরু হলেও হাসপাতালের সামান্য কর্মচারীটাও বাদ যায় না সিন্ডিকেট থেকে।

সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সিন্ডিকেট বাণিজ্য সৃষ্টি করে। আপনি আমি যেখানে হাসপাতালে গিয়ে একটা সিটের জন্য, একটা হুইল চেয়ারের জন্য কর্মচারীকে ৫০/১০০ টাকা দিতে বাধ্য তখন আমরা কীভাবে মন্ত্রণালয় থেকে সৃষ্ট হওয়া সিন্ডিকেট ভাঙার স্বপ্ন দেখব? আমি বলছি না অসম্ভব। সংস্কার করার জন্য এ দেশে গণ-অভু্যত্থান হয়েছে। সংস্কার হবে সেই স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। তবে এসব স্থানেও যেন সেসব সংস্কার হয় সেটার প্রত্যাশাও সবাই রাখে। একদম নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সবখানেই প্রয়োজন সংস্কার। প্রয়োজন আইনের শাসন, প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়া। এসব প্রতিষ্ঠা না হলে এই সেক্টরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ, সিন্ডিকেট বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেটা নির্মূল করা অসম্ভব।

আজহার মাহমুদ : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে