ভেজাল রোধে কঠোর হোন
এই কঠোর অভিযানে যাদের এই অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাওয়া যাবে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করতে হবে এবং কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে জনসম্মুখে।
প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আরিফ আনজুম
দেশে যেন আজ অরাজকতা ও নকলবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। নকল ভেজালের বিরুদ্ধে বছরজুড়ে অভিযান চললেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। বর্তমানে দেশে শাসনরত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিংগুলোর মধ্যে এটিও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। লঘু সাজার কারণে নকল ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই থামছে না। সারাদেশে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মানহীন পণ্য। এর ফলে, ক্রেতারা যেমন প্রতারিত হচ্ছে তেমনি হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যও। এমনিতেই মানহীন কিংবা ভেজাল পণ্য উৎপাদকদের শাস্তি খুব একটা হয় না। এছাড়া পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতারও অভাব রয়েছে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির তৎপরতাও সীমিত। ভেজাল ও মানহীন পণ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান অনেকাংশ রাজধানীতেই সীমিত। ঢাকার বাইরে তৎপরতা নেই বললেই চলে।
খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো সচেতন মানুষের পক্ষে কোনো খাদ্যই স্বস্তির সঙ্গে খাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বাজারে যে সব জুস ও পানীয় বিক্রি হয় তার সিংহভাগই মানসম্মত নয়। নামিদামি কোম্পানির তৈরি করা মিষ্টি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে যে ঘি, বাটার অয়েল ও ভোজ্যতেল বিক্রি হয় তার সিংহভাগই নকল ভেজাল। শিশু খাদ্যের মানও প্রশ্নবিদ্ধ। দুধে ভেজালের রাজত্ব বিরাজ করছে যুগ যুগ ধরে। এখন যেসব প্যাকেটজাত দুধ বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই মানসম্মত নয়। আম, কলা, আপেল, খেজুর ইত্যাদি ফল খেতে ভয় পায় এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো ফল পুষ্টির বদলে মানুষকে আরও রোগাক্রান্ত করছে এসব খাবার দুষ্কৃতকারীদের জন্য। খাদ্যে নকল ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ বা মোবাইল কোর্টের অভিযান যেমন অব্যাহত রাখতে হবে তেমনি এ জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। প্রতিটি পাড়া মহলস্নায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তারা দেশ ও জাতির শত্রম্ন। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত এ অপক্রিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক ভেজাল মেশানোর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন। আদালত নির্দেশে বলেছেন, বারবার বলার পরেও ভয়ংকর এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকারের ঢিলেঢালা মনিটরিং ব্যবস্থা এবং ভেজালের বিরুদ্ধে আইনের যথার্থ প্রয়োগ না হওয়ার কারণেই খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর প্রবণতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। খাদ্যে নকল ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। প্রতিটি পাড়া মহলস্নায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে নকল ভেজালের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্যে ভেজালকারীদের সামাজিক ভাবে চিহ্নিত করে কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজাল বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নেবে- আমরা তেমনটিই দেখতে চাই। কারাদন্ডের পাশাপাশি অর্থদন্ড এমনভাবে বাড়াতে হবে- যাতে অপরাধীরা ভয় পায়। প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রধানকে পণ্য ভেজাল রোধের দায়িত্বে সম্পৃক্ত করতে হবে।
দেশে নকল ভেজালের দৌরাত্ম্য কীভাবে বাড়ছে তার প্রমাণ মেলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে যে সব খাদ্য পণ্য পরীক্ষার জন্য যায় তার দুই-পঞ্চমাংশের মধ্যে ভয়াবহ ভেজালের প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিশুখাদ্যেও চলছে যথেচ্ছভাবে ভেজাল। জনস্বার্থে এ ব্যাপারে সরকারকে আইনগত ব্যবস্থা যেমন জোরদার করতে হবে, তেমনি নকল ও ভেজাল প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোতে লোকবলও বাড়াতে হবে। জনমানুষের উদ্বেগ ও ভেজালের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে উচ্চ আদালত থেকেও একাধিকবার সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ যে বিশেষ কিছুই হয়নি তার প্রমাণ জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে সম্প্রতি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল। সেখানে দোকান থেকে সংগ্রহ করা মিষ্টির সব নমুনাই ভেজাল এবং সয়াবিন তেলের সংগৃহীত নমুনায় ৭৫% ভেজাল পাওয়া গেছে। ভেজাল পাওয়া গেছে সরিষার তেল, লবণ, হলুদের গুঁড়া, মধু, গুড়, বিস্কুট, ডাল, সেমাই, জেলিসহ অনেক খাদ্যপণ্যে। তাহলে মানুষ খাবে কী? জীবন ধারণ করবে কীভাবে? সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্য চিহ্নিত করা অসম্ভব।
আমজনতার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন, শুধু নীতিজ্ঞানহীন কিছু মানুষের অত্যন্ত ক্ষতিকর লোভের শিকার হতেই থাকব আমরা সাধারণ নাগরিক? এর আগেও বিভিন্ন সময় খাদ্য পরীক্ষায় প্রায় একই ধরনের তথ্য ওঠে এসছে। কোন পণ্যে কী ভেজাল তা এত বেশি আলোচিত যে, সাধারণ মানুষেরও মুখস্থ হয়ে গেছে। যেমন- মাছে ও দুধে মেশানো হয় ফরমালিন। ফলমূল পাকাতে ব্যবহৃত হয় কার্বাইড। মুড়িতে ইউরিয়া, শুঁটকি তৈরিতে ডিডিটি, গুঁড়া মসলা, চানাচুর ও রঙিন খাবারে ব্যবহার করা হয় শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কাপড়ের রং, সবজিতে সরাসরি কীটনাশক স্প্রে করা হয় এবং কীটনাশক সক্রিয় থাকতেই সেগুলো বাজারজাত করা হয়। মুরগির খাবার বা পোলট্রি ফিড তৈরি হয় ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে। তাতে থাকে ক্রোমিয়ামসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য। মুরগির মাংসের মাধ্যমে সেগুলো মানব দেহে চলে আসে। থাকে অতিরিক্ত অ্যান্টি-বায়োটিকের উপস্থিতি। এমনি আরও কত কী! এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের এ ক্ষেত্রে করার কী আছে? সরকারকে তাই এ ব্যাপারে আরও কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে যে সময়টা প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই সময়টার মধ্যে গুরুদায়িত্ব হিসেবে কঠোর অভিযান চালাতে হবে।
এই কঠোর অভিযানে যাদের এই অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাওয়া যাবে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করতে হবে এবং কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে জনসম্মুখে।
এতে করে পরবর্তী সময়ে আর কেউ এমন অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ব্যবসা পরিচালনার পূর্বে অন্ততপক্ষে একবার হলেও ভাববে এবং এই বিপদের মুখ থেকে আমরা সাধারণ আমজনতা মুক্তি পাব।
আরিফ আনজুম : কলাম লেখক