অন্ধকারে মশারাও বেহুদা শব্দে বেপরোয়া উৎপাত করে। বিদঘুটে অন্ধকারে আলোর উপস্থিতি ঘটলেই মশারা যেন সভ্যতার সন্ধান পায়, ফলে শব্দ করা বন্ধ করে দেয়, কামড়াকামড়ি প্রায় কমিয়ে দেয়। কিন্তু মানুষ! এ দেশের রাজনৈতিক দলের সমর্থকগোষ্ঠী অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরে এলেও চোখে আলোর দেখা পায় না। সমর্থকগোষ্ঠীই এ দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। সমর্থকগোষ্ঠীর মাঝে রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা বিদ্যমান থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো আলিফের মতো সোজা হয়ে গোলামের চেয়ারে বসত আর উঠত। ৩৫০ জন মানুষ জনপ্রতিনিধির লেবাস পরিধান করে ১৮ কোটি মানুষকে অস্থির করে রাখে। ভাবা যায়, এই দেশের মানুষ রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় কত অসচেতন! এসব আক্ষেপের ভাবনা জুলাই বিপস্নবের সময়ে ছিল। কিন্তু এখন ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের পর দেশের রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ এসেছে। স্বৈরাচার সরকারকে উৎখাত করে দেশকে বাঁচাতে রাজনীতির চিন্তাচেতনায় এ দেশের তরুণরা জুলাই-আগস্ট মাস নির্ঘুম কাটিয়েছে। দেশের মানুষ এখন রাজনীতি বিষয়ে সচেতনতা অর্জনে গ্রামের চায়ের টং থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে আলোচনার ঝড় তুলছে। আমরা আশাবাদী অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরে নতুন এক বাংলাদেশেকে দেখতে পাব। যেখানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জনগণের অধিকার রক্ষার্থে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। জনগণও সরকারের স্বচ্ছতা ও কপটতা বুঝতে সক্ষম হবে। ফলে সরকার জনমতের বাইরে গিয়ে অগণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ, অপশাসন, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অন্যায়-অত্যাচার, প্রতিহিংসার রাজিনীতি চর্চা করলেই স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করবে। যে সরকারই আওয়ামী লীগ সরকারের মতো স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করবে তাকেই এ দেশের ছাত্র-জনতা রুখে দেবে।
দীর্ঘ সাড়ে পনেরোটা বছরে আওয়ামী কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্রের সব কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করে রাখার জন্য যথেচ্ছায় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করেছে। স্বৈরাচারী সরকারের এক হাতে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো পরিচালিত হয়েছে। স্বৈরাচারী কর্মকান্ডের জন্য রাষ্ট্রের কারো কাছেই জবাবদিহিতা করতে হয়নি। আওয়ামী অবৈধ সরকার বিনা ভোটে বারবার ক্ষমতা দখল করতে নিজের খেয়াল-খুশি মতো পরিবর্তন-সংশোধন করেছে সংবিধান; দোসর হিসেবে ব্যবহার করেছে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, আমলা, বিশ্বদ্যিালয়ের তথাকথিত ছাত্র-শিক্ষক, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগ, পুলিশ বাহিনীকে। গণতন্ত্রের নাম করে স্বৈরতন্ত্রের শিকল পরিয়ে জনগণের ওপর অযাচিত নিপীড়ন-নির্যাতন করেছে। খুনি সরকারের বিচারবহির্ভূত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই অন্যায়-অত্যাচার, মামলা-হামলা, গুম-হত্যা চালিয়েছে। পলাতক সরকারের পালিত পেটোয়া বাহিনী দ্বারা জনগণকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখত, যেন কেউ সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কথা না বলতে পারে। জনজীবনকে দুর্ভোগে ফেলে আওয়ামী সরকারের দোসর কুচক্রীমহলকে দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, টাকা পাচার, ব্যাংক লুটপাট, কালো টাকা, সব অবৈধ কর্মকান্ডের বৈধতা দিয়েছিল- ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। ফলে মুষ্টিয়ে রাক্ষুসে অমানুষের কাছে দেশের ১৮ কোটি মানুষ জিম্মি ছিল। অন্যায়-অত্যাচারে দেশের মানুষ বাকস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, ভোটাধিকার, নিত্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। পনেরোটা বছরের অপশাসনে জনগণকে ঘরভিটে বোবা করে রেখেছিল। সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ওহু! শব্দটা পর্যন্ত করতে দিতে চায়নি। স্বৈরাচার সরকারের সমালোচনা করলেই হয় গলা চিপে ধরেছে, না হয় হামলা-মামলা, গুম-হত্যা করেছে।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথাকথিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৪৩৬টি মামলা হয়েছে এবং ৪৫২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সত্য নিউজ করলেই মামলা খেয়েছে। জনগণ সামাজিক মাধ্যমে সরকারের কর্মকান্ডের সমালোচনা করলেই মামলা খেয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে রাজনীতিবিদ মামলায় জর্জড়িত হয়ে বছরের পর বছর কারাবন্দি থেকেছে। লেখক মুশতাক আহমেদের কথা মনে আছে? যিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দি হয়ে স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচারে কারাগারেই মৃতু্যবরণ করেছিল। তিনি ২০২০ সালের মে মাসে গ্রেপ্তারের আগে তার একটি ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশ সরকারের কোভিট-১৯ মহামারি ব্যবস্থা সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেন এবং লিখেন, 'যখন একটি সমাজ মানুষের জীবনহানির চেয়ে অর্থনীতির ক্ষতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে, তখন তার ভাইরাসের প্রয়োজন হয় না, এটি ইতোমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।' ভাবা যায়! এই পোস্টের কারণে মামলা, কারাবরণ, মৃতু্যবরণ। লেখক মুশতাক আহমেদের মতো অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণ খুনি সরকার কেড়ে নিয়েছে। জুলাই বিপস্নবের সময়ও তো তাই করেছে, শত শত ছাত্র-জনতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে মেট্রোরেলের ভাঙা ইট-পাথরের জন্য মায়াকান্না করেছে। লেখক মুশতাকের মতো অসংখ্য মানুষের ওপর করা অন্যায়-অত্যাচার দেখেই জনগণের উচিত ছিল ২৪-এর নির্বাচনেই স্বৈরাচার সরকারকে রুখে দেওয়া। তাহলে শত শত তরুণের তাজা প্রাণের বিনিময়ে খুনি সরকারকে উৎখাত করতে হতো না।
মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শাসনামলে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ২৬৯৯ জন। এ সময়ে গুম হন ৬৭৭ জন, কারাগারে মৃতু্যবরণ করেন ১০৪৮ জন। কেমন অমানবিক সরকারের অধীনে ছিল এ দেশ- যেখানে ১৪ বছরে হত্যা করেছে ২৬৯৯ জনকে, সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাত্র ২০ দিনের মধ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে খসড়া তালিকা অনুযায়ী ৭১৭ জনকে। এর মাঝে ৩২ জন নিষ্পাপ শিশুরও প্রাণ ঝরে গেল। হত্যাকান্ড, গুম, কারাগারে মৃতু্যবরণ এর কারণ অধিকারের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন বজায় রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। অকার্যকর বিচার ব্যবস্থার কারণে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ব্যবহার করে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সরকারের সমালোচক, ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনের কাজে সরকারের পক্ষে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ব্যবহার করা হয়। এসব বিচাবহির্ভূত হত্যা, গুম-খুনের ঘটনার মধ্যে নির্যাতনের হত্যা, ক্রসফায়ার, হত্যা ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গুলি, ব্যবসায়ীদের আটক করে মালামাল লুট, নাগরিকদের গ্রেপ্তারের দেখিয়ে টাকা আদায়ের মাধ্যমে এসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। (বণিক বার্তা, ১২ আগস্ট, ২০২৪)
কর্তৃত্ববাদী সরকার গত সাড়ে পনেরো বছর ধরে রাষ্ট্র, সংবিধান, গণতন্ত্র, জনগণ, সুশাসন, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার উপেক্ষা করে দেশকে ত্রাসের রাজত্বে পরিণত করেছিল।
\হএক নায়কতন্ত্র কায়েমের পথেই হাঁটছিল শেখ হাসিনার সরকার, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ দেশের মুক্তিকামী-সংগ্রামী জনগণ তা হতে দেয়নি। যে দেশের মাটির পরতে পরতে '৫২, '৬৯, '৭১ এবং '৯০-এর চেতনা মিশে আছে, সে দেশে এক নায়কতন্ত্র কায়েমের স্বপ্ন দেখা যে অসম্ভব দুঃস্বপ্ন দেশের ছাত্র-জনতা আবার ২৪-এর জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থান ঘটিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ দেশের জনগণ সব ধর্ম, গোষ্ঠী এবং বর্ণের মানুষের সমান অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। এ দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতার জোরে ধরে রাখার চিন্তা অসম্ভব। জুলাই বিপস্নবের শত শত শহীদ ও আহত বীরদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে জনগণের কল্যাণকামী আদর্শ রাষ্ট্র গড়ার সুযোগ এসেছে। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কার করে যেতে হবে, তা আপামর জনতার প্রাণের দাবি। গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার, ভোটাধিকার, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার এবং কোনো সরকারই যেন স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করতে না পারে এমন রাষ্ট্র গড়তে হবে। আওয়ামী সরকার দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের কাঠামো বাতিল বা পরিবর্তন করতে হবে। ইতোমধ্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে- নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন। এসব কমিশনের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারও এই সরকারকেই করে যেতে হবে। জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করতে এসব সংস্কার কাজে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে সফল হতেই হবে। সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারে জনগণ এবং সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতাও অনিবার্য। দেশের সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে সমস্ত বিকল রাষ্ট্রযন্ত্র যথাযথভাবে সচল করতে হবে। সর্বোপরি, এত রক্তক্ষয়ের ফসল এই ছাত্র-জনতার বিপস্নবকে বিফল হতে দেওয়া যাবে না। এই বিপস্নব বিফল হলে এই জাতির মুক্তি আর কবে কীভাবে মিলবে তা বলা বড় মুশকিল।
মো. আব্দুন নূর : কলাম লেখক