রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আমাদের দায়বদ্ধতা

সংবিধানকে শুধু কাগজে-কলমে বন্দি রাখলে স্বাধীনতা মূল চেতনা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না। সংবিধানের মূলনীতির ওপর আমাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ভবিষ্যতে কোনো দলীয় সরকার স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার না করতে পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সামনের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

কে এম মাসুম বিলস্নাহ
স্বাধীনতার পর সময়টা প্রায় ৫৩ বছর, আমাদের ফিরে তাকাতে হবে বিগত দিনগুলোর দিকে! আমাদের দেখতে হবে কতটুকু অর্জন আমরা জাতি হিসেবে করতে পেরেছি, কতটুকুই বা পিছিয়েছি! অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিবেচনায় হয়তো বলা চলে আমরা কিছুটা এগিয়েছি- তবে শুধু কাঠামো ও অবকামোগত উন্নতি বিবেচনা করলেই চলবে ব্যাপারটা পুরোপুরি সেরকম নয়, আমাদের দেখতে হবে আমাদের সংবিধান আমরা কতটুকু রক্ষা করে চলতে পেরেছি! বিশেষ করে আমাদের সংবিধানের ২য় খন্ডে বলা আছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির কথা। মূলত চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের সংবিধানের মূলনীতি গঠিত হয়েছে। সংবিধানের ৮-১২ অনুচ্ছেদে যে চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। সংবিধানের ৮(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে 'এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না' অর্থাৎ এই চারটি নীতির ওপর ভিত্তি করে দেশ পরিচালিত হওয়ার কথা। তাই আমাদের বিবেচনা করতে হবে স্বাধীনতা এত বছর পর সংবিধানের মূলনীতির ওপর দেশ পরিচালিত হচ্ছে কিনা? গণতন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ 'জনগণের শাসন', গণতন্ত্রের সব থেকে গ্রহণযোগ্য ও সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা দিয়েছেন আব্রাহাম লিংকন, তার মতে 'গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য'! বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হলেও গণতন্ত্র এখানে বারবার হোঁচট খেয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে একাধিকবার সামরিক শাসন থেকে শুরু করে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থেকেছে। শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতাগ্রহণের মাধ্যম হচ্ছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, সেই স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়নি? বিশেষ করে বিগত আওয়ামী সরকারের অধীনে একাধিক জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় শাসন নির্বাচনগুলো বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে! এছাড়াও ২০১৪ সালে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন এমপি নির্বাচিত হওয়াকে সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনসহ সুশীল সমাজ 'অগণতান্ত্রিক' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় ১৫৩ জন অনির্বাচিত (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) সংসদ সদস্য হিসেবে পাঁচ বছর সংসদে অংশগ্রহণ করেছেন! এতে করে সাধারণ মানুষ যেমন নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেনি তেমনি সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে! নির্দলীয় সরকারের অধীনে গুটি কয়েক নির্বাচন তুলনামূলক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কি বিতর্ক ছাড়া হয়েছে? সম্ভবত হয়নি, আর এ কারণেই বলা যায়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হয়েও নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকারের অধীনে স্বতন্ত্রত্মভাবে কখনো কাজ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল একটি বড় ভূমিকা পালন করে- যারা জনগণের বিপক্ষে নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ থেকে শুরু করে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে পরিশুদ্ধ করার ভূমিকা পালন করে। তবে বিভিন্ন সময় বিপরীত মত দমন নীতির ফলে শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরি হয়নি বিশেষ করে সর্বশেষ একাধিক নির্বাচনে বিরোধী দল বলতে তেমন কোনো শক্তিশালী দল ছিল না। এক্ষেত্রে বিগত সরকার ও অন্যান্য দলগুলো তাদের দায় এড়াতে পারে না। এর প্রভাব পড়েছিল সাধারণ জনগণের ওপর; তাছাড়া শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সংসদও তার প্রাণ হারিয়েছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল, সেটি সাধারণ জনগণের কাছে তুলনামূলক ভালো পদ্ধতি বলা হলেও বিগত সরকারের আমলে সেটিকে 'গণতান্ত্রিক নয়' এবং 'সর্বোচ্চ আদালত ওই বিধানের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন' যুক্তিতে ২০১০ সালে বিধানটি সংবিধান থেকে বাতিল করা হয়। তবে পুনরায় তত্ত্বধায়ক সরকার ফিরবে কিনা সেটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না- তবে বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে নির্দলীয় তত্ত্বধায়ক সরকারের বিকল্প নেই এবং পরিবর্তী সময়ে কোনো সরকার যাতে নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের হাতিয়ার বানাতে না পারে সে বিষয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়াও নির্বাচন কমিশনকেও ঢেলে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের পাশাপাশি সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে মানবাধিকারের কথা। যদিও বিভিন্ন মানবাধিকার সূচক বলছে আমরা মানবাধিকার বিষয়ে বিশ্বে মাঝামাঝি অবস্থানে আছি তবে মানবিকতার লঙ্ঘনের ঘটনা বারবার আমাদের সামনে এসেছে। বিশেষ করে যুদ্ধপরিবর্তী সময় থেকেই বিরুদ্ধমত দমনের চেষ্টা, বিরোধী দলগুলোর প্রতি সরকারি দলের দমন পীড়ন নীতি, কিংবা সর্বশেষ সরকারের আমলে গুম খুন ও আলোচিত আয়নাঘরকান্ডের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। এছাড়াও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে বিগত বছরগুলোতে। তাই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে অনবরত আমেনেস্টি ইস্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইট ওয়াচ-এর কাছ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে।র্ যাব, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী সরকারের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তবে এর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তবে হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের লোক সমান সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলেও বিভিন্ন ইসু্যতে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে কিছু রাজনৈতিক দল এই সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে এর ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করা থাকে বিভিন্ন সময়। তবে উপমহাদেশের ইতিহাস বলে এখানে সাম্প্রদায়িকতার যে বীজবপন করা হয়েছিল দেশভাগের সময় তার প্রভাব মাঝে মাঝে উপমহাদেশের দেশগুলো পরে। তবে স্বাধীনতা এই দীর্ঘ যাত্রায় বড় ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িকতা দাঙ্গা কিংবা সংখালঘুদের ওপর বড় কোনো নির্যাতনের ইতিহাস নেই। এ দেশের সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। এটা অবশ্য আমাদের জন্য একটি ভালো দিক। তবে ধর্ম নিরপেক্ষতারর পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতার কথাও বলা হয়েছে একই অনুচ্ছেদে। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় বাদ দিলে সামগ্রিকভাবে এ দেশের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে- যা স্বাধীনতার পর থেকে আজ অব্দি বিদ্যমান আছে। সমাজতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হলো সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা- যাতে সমাজে শ্রেণি বৈষম্য ও শোষণ বিলুপ্ত হয়। তবে এখানে একটা বড় প্রশ্ন থেকে গেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা কি আমাদের দেশের সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ণ? উত্তর অবশ্যই নয়, এখানে যখন যারা ক্ষমতায় থেকেছে তারা সাধারণের প্রতিনিধি হওয়ার থেকে উপনিবেশিক ভাবধারার শোষক বেশি হয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কিংবা একশ্রেণির মানুষের মানসিকতা ছিল সম্পদের কুক্ষিগতকরণ! এর ফলে, সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশে অধিকতর ধনকুবের তৈরি হয়েছে বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অধিকাংশ মানুষ। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা মাফিক সব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়- তাই এই অর্থব্যবস্থায় বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষপট ভিন্ন। বেকারত্ব আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। যার ফলে, বড় অংকের যুবসমাজ দেশের কল্যাণে কোনো কাজে আসছে না! ধনী-গরিব বৈষম্য, শাসকদের শোষক বনে যাওয়া, কিংবা বেকারত্ব থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন বৈষম্যের কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে আমাদের সংবিধানে যে সমাজতন্ত্রের কথা বলে আছে তা কেবল কাগজেই লিপিবদ্ধ! সুতরাং, বলাই যায়, সমাজতন্ত্রের মূলভিত্তি আর আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থা অনেকটাই সাংঘর্ষিক। আমাদের এখন সুযোগ এসেছে এসব অসঙ্গতি নিয়ে ভাবার। সংবিধানকে শুধু কাগজে কলমে বন্দি রাখলে স্বাধীনতা মূল চেতনা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না। সাংবিধানের মূলনীতির ওপর আমাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ভবিষ্যতে কোনো দলীয় সরকার স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার না করতে পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সামনের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কে এম মাসুম বিলস্নাহ : কলামিস্ট ও ব্যাংক কর্মকর্তা