পুলিশ বাহিনীতে সংকট প্রশাসনিক সংস্কার ও নৈতিকতা পুনর্গঠন জরুরি

বাংলাদেশের বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের সংকট শুধু একটি সাময়িক সমস্যা নয়, বরং দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিফলন।

প্রকাশ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরকার সংকট এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসেছে। আন্দোলনের পরবর্তী পুলিশ প্রশাসনের ১৮৭ জন সদস্যের কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর ভিত্তিতে পুলিশের ক্ষমতা কাঠামো ও শৃঙ্খলার দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। এ ঘটনা শুধু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই অস্থিতিশীল করেনি, বরং রাষ্ট্রের পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন, যাদের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন। লাপাত্তা হওয়া এই সদস্যদের মধ্যে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার, ডিআইজি এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছেন। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, এই কর্মকর্তারা আর চাকরিতে ফিরতে পারবেন না এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশের পুলিশের ইতিহাসে এ যেন এক অদ্ভুত অধ্যায়, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, যিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেন, তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ৩৮টি। হারুনের সঙ্গে আলোচিত আরেক কর্মকর্তা বিপস্নব কুমার সরকারও কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণ-অভু্যত্থান এবং তার আগে-পরে সংঘটিত হত্যাকান্ডের দায়ে একাধিক মামলা রয়েছে- যা তাদের প্রভাবশালী রাজনৈতিক অবস্থানের ফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। জনসাধারণের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই কর্মকর্তাদের এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার না হওয়া এবং পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা আরও হ্রাস পাচ্ছে। লাপাত্তা কর্মকর্তাদের তালিকায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও এসআই, এএসআই, নায়েক এবং কনস্টেবলরাও অন্তর্ভুক্ত আছেন। এই কর্মকর্তারা ছাত্র আন্দোলনের সময় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন এবং তারা আইন প্রয়োগে অবহেলা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের এই ধরনের কর্মকান্ড তাদের প্রতিষ্ঠানগত দুর্বলতা এবং দায়বদ্ধতার অভাবকে সামনে নিয়ে এসেছে। ফলে, দেশের সাধারণ মানুষের মনে পুলিশের ওপর আস্থা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অব্যবস্থাপনা এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক যোগাযোগ তাদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, খন্দকার নুরুন্নবী, এস এম মেহেদী হাসান এবং সঞ্জিত কুমার রায়ও পলাতক তালিকায় আছেন। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর গুলির নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু তাদের বিচার প্রক্রিয়া এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন বরাবরই রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার। এর ফলে, আইন প্রয়োগে পক্ষপাতিত্ব এবং দুর্ব্যবহার সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিআইজি হারুন অর রশীদ এবং বিপস্নব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগের সংখ্যা এ বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে। হারুন অর রশীদ যেমন ছাত্র আন্দোলনের সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন, বিপস্নব কুমার সরকারও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা জয়নাল আবদীন ফারুককে নির্যাতনের ঘটনায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ধরনের ঘটনা শুধু পুলিশ প্রশাসনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেনি, বরং রাষ্ট্রের আইনের শাসন নীতির প্রতি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ২০১১ সালে বিপস্নব কুমার সরকারের তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদীন ফারুককে নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে, তাকে তৎকালীন সরকারের গুডবুকে জায়গা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন পদোন্নতি- যা পুলিশ প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে আইনের অপব্যবহারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। পুলিশ বাহিনীতেও অভ্যন্তরীণ বৈষম্য ও ক্ষোভ বিদ্যমান ছিল। বহু কর্মকর্তা প্রায় দুই দশক ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত থেকে কাজ করছেন- যা তাদের মধ্যে গভীর হতাশা তৈরি করেছে। এই ধরনের বৈষম্য পুলিশ বাহিনীর কর্মক্ষমতা ও মনোবলকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে অবহেলিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার না পাওয়ার হতাশা থেকে মানসিক চাপ এবং অপ্রাপ্তির বেদনা তাদের দায়িত্ব পালনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে, এমন একটি সময়ে যখন পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা ও মনোবল সর্বোচ্চ হওয়া উচিত ছিল, তখন তাদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও বৈষম্য পুলিশের সামগ্রিক দক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদিও গণ-অভু্যত্থানের পর থেকে প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেছে, তবুও দেশের বিভিন্ন অংশে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশের কার্যক্ষমতা গড়ে উঠতে পারেনি। পুলিশ সদস্যদের পলায়ন এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার ধীরগতি আইনি ব্যবস্থার দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দ্রম্নত শক্তিশালী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, লাপাত্তা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই দেশ ত্যাগের চেষ্টা করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও, কার্যত তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পুলিশ সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে বিচার ব্যবস্থা দুর্বল করা হচ্ছে- যা আইনের শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরও কমিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের সংকট শুধু একটি সাময়িক সমস্যা নয়, বরং দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিফলন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের দায়িত্বহীনতা, শীর্ষ কর্মকর্তাদের পালিয়ে যাওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি রাষ্ট্রের আইনের শাসন ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে প্রশাসনিক সংস্কার, পুলিশ বাহিনীর নৈতিকতার পুনর্গঠন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রম্নত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও লেখক