বেকারত্ব দূর হোক

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সাকিবুল হাছান
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে বেকারত্ব। দিন দিন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে বেকারত্বের সংখ্যা। যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। একজন মানুষ যখন তার পেশা অনুযায়ী কাজ খুঁজে পায় না তখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তাকে বেকারত্ব বলে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুযায়ী, যারা ৭ দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং গত এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ৫ আগস্ট নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়। যার মূলে ছিল এদেশের সাধারণ শিক্ষার্থী। তবে শুরুটা ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া। যাতে দেশে বেকারত্বের মাত্রা কমানো যায়। কিন্তু পরে এই আন্দোলনে সরকার পতনে হয় যা দেশের সব মানুষ অবগত আছেন। '২৪-এর আন্দোলন, অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, কেড়ে নেয় অনেক শিক্ষার্থীর চোখ, পঙ্গুত্ববরণ করেন অনেকেই। তাদের আত্মত্যাগের কারণে আজকের এই নতুন বাংলাদেশের সূচনা। যেহেতু শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ ছিল মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে দেশের বেকারত্বের মাত্রা শিথিল করা। আর তাই এই নতুন বাংলাদেশ হোক বেকারত্ব মুক্ত। এদেশের বেকারত্ব দূর করার জন্য, বেকারত্বের বর্তমান পরিসংখ্যান, কারণ এবং সমাধান নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। তাহলে কাঠখড় পুড়িয়ে পাওয়া নতুন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বেকারত্বের মরণ ছোবল থেকে রক্ষা পাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। গত নভেম্বর মাসে দেশের বেকারত্বের হার ৬.৯১ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চ হলেও তা তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরি তৈরি করার মতো যথেষ্ট হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। তারা বেকারত্বের অসহ্য যন্ত্রণায় জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। ফলে দেশে সর্বত্র দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা। ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো যে কোনো সময় ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের হার বাংলাদেশেই বেশি। কিন্তু এই শিক্ষিত তরুণরা দেশের বোঝা নয়, মূলত দেশের সম্পদ! বেকার নারী-পুরুষ কাজের অনুসন্ধান করছেন, কিন্তু তারা পাচ্ছেন না। বাবা-মা ছেলে বা মেয়েটির পথ চেয়ে বসে থাকে, কখন তারা পড়াশোনা শেষ করে পরিবারে সচ্ছলতা আনবে, তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী যখন অনার্স মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি পায় না তখন তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। কাজের সুযোগ না পেয়ে অনেকে মাদকসহ নেশাজাতীয় নানাবিধ অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। হতাশায় জীবন কাটাচ্ছে। অনেকেই বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। একজন বেকারের নীরব যন্ত্রণা কেউ অনুভব করতে পারে না, কেউ বুঝতে চায় না তাদের অনুভূতি। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সেশনজট, জরাজীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে দিন দিন বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। ইউনেস্কোর এক গবেষণায়, শিক্ষা হলো দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান শর্ত। কিন্তু আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা তা শিক্ষিত জাতির কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে কী? একজন স্নাতক বা স্নাতকোত্তরধারী কিংবা শিক্ষিত তরুণ তার পড়ালেখা শেষে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে কাজ না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশ যাচ্ছে ফলে দেশ মেধাশূন্য হচ্ছে। ২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৫৭টি দেশে প্রায় ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশ গমন করেন। ২০২২ সালে ১১ হাজার শিক্ষার্থী শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু কেন? ইউনেস্কোর তথ্য বলছে, ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি জমায়। প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন মেধাবীরা ফলে নীরবে 'মেধা পাচার' হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? কারণ দেশে চাকরির অনিশ্চয়তা, শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্যের রাজনীতি, বিদ্যাপীঠে অনুকূল পরিবেশ না থাকা, লেখাপড়ার বৈশ্বিক মানের ঘাটতি। বাংলাদেশে লেখাপড়া করেও বেকার থাকতে হয়। এখানে চাকরির নিশ্চয়তা নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ শিক্ষিত বেকার শ্রমবাজারে আসছে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ হলেও মিলছে না কাজ অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় বিদেশ থেকে উঁচু বেতন দিয়ে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন। অর্থাৎ আমরা যোগ্য লোকবল তৈরি করতে অপারগ। শিক্ষিত তরুণদের মেধা ও শ্রমশক্তি যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে। এতে বেকারত্বের বোঝা লাঘব হবে। বিআইডিএস গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ জায়েদ মনে করেন, প্রতিবছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি এবং অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় না করলে এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। শিক্ষাকে যদি কর্মমুখী করে তোলা যায়, তবে শিক্ষিতদের চাকরি পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না। একজন শিক্ষার্থী যখন কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হবে তখন সে সাবলম্বী, আত্মনির্ভরশীল হবে ফলে সে তার যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান করে নিতে পারবে। দক্ষ মানুষই পারে একটি দেশকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু দক্ষতা না থাকলে ভালো কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ অদক্ষরা সমস্যার সমাধান করতে পারে না বরং সমস্যা বাড়ায়। তাই দক্ষ মানুষ তৈরিতে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দরকার। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বেকার তরুণ ও তরুণীদের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আমাদের তরুণ সমাজকে রক্ষা করার জন্য চাই মাঠ পর্যায় থেকেই উদ্যোগ। এ ছাড়া দেশের তরুণ সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা। তাহলেই আমাদের নতুন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। সাকিবুল হাছান \হঢাকা কলেজ, ঢাকা।