'অ ঢ়বৎংড়হ রং ঢ়ৎবংঁসবফ রহহড়পবহঃ ঁহঃরষ ঢ়ৎড়াবহ মঁরষঃ' অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে নির্দোষ বলে ধরে নেওয়া হয় যতক্ষণ না সে দোষী প্রমাণিত হয়।' এটি ফৌজদারি আইনের একটি মৌলিক নীতি। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরই কেবল তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। তবে শাস্তি দেওয়ার অধিকার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা জনতার নেই। যদি কেউ বিচার নিজ হাতে তুলে নেয়, তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে মব জাস্টিসের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ার বাহিরে গিয়ে অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার সংস্কৃতি বিদ্যমান, যা বেআইনি এবং নীতিবিরুদ্ধ কাজ।
মব (সড়ন) অর্থ উত্তাল বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা, জাস্টিস (ঔঁংঃরপব) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। মব জাস্টিস অর্থ উত্তাল বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। কোনো একটা অভিযোগের ভিত্তিতে জনতা নিজ হাতে বিচার তুলে নেওয়াকে মব জাস্টিস বলে। কাউকে মেরে আহত করা, ঘরবাড়িতে আগুন লাগানো, দোকানপাট ভাঙচুর ইত্যাদি মব জাস্টিসের অংশ। মব জাস্টিসের চূড়ান্ত রূপ মব লিঞ্চিং (ষুহপযরহম)। জনতার গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে তাকে বলে মব লিঞ্চিং তথা বিচারবহির্ভূত হত্যা। পূর্বে গণপিটুনিতে চোর-ডাকাত নিহতের অনেক ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৮৬ জন। এমনকি ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর থেকে জুলাই পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৩২ জন। বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের বর্বরোচিত গণহত্যা, দুর্নীতি, দেশের সম্পদ লুটপাট, গুম-খুনের পর রক্তক্ষয়ী গণ-অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচার সরকারের। সেই সঙ্গে নতুন মাত্রায় শুরু হয় মব জাস্টিস আতঙ্ক। স্বৈরাচারের দোসরদের ঘরবাড়িতে আগুন, দোকানপাট ভাঙচুর, খুনের সঙ্গে জড়িতদের গণপিটুনিতে মৃতু্যর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। একই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অথচ মব জাস্টিসের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিচার করার কারণে একজন ব্যক্তি আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ পায় না। পরিতাপের বিষয় হলো- মব জাস্টিসে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি প্রাণও দিতে হয়। সম্প্রতি চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃতু্য হয় মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবকের, যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নক্কারজনক ঘটনা।
মব জাস্টিস বা জনবিচারের উলেস্নখযোগ্য কিছু কারণ হলো- সমাজে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়া, আইন সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা, আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা, দ্রম্নত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে না পারা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালনে অদক্ষতা ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রকৃত বিষয় না জেনে গুজব শুনে বা উস্কানির ফলে মবে অংশ নেওয়ার ঘটনাও অহরহ। পত্র-পত্রিকায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। মব জাস্টিসে আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর উন্মত্ত জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের ফলে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ হয়, সেটা বেশিরভাগ মানুষ জানেই না? ফলে চোর-ডাকাত ধরা পড়লে মব লিঞ্চিংয়ে মৃতু্য ঘটানো অনেক আগেই বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সংবিধানে মানবাধিকার নিশ্চিতের বিধান থাকলেও প্রচলিত আইনের মাধ্যমে মব জাস্টিসের শাস্তি দেওয়া কষ্টসাধ্য। ফলে গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ার অপরাধে বাংলাদেশে কারও দন্ড হওয়ার নজির নেই। মব জাস্টিসের অসুস্থ চর্চা থেকে সমাজকে বের করতে হলে মব জাস্টিসের নামে যা হচ্ছে, তা যে বেআইনি, সে ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং দ্রম্নত সময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। চলমান পরিস্থিতিতে মব জাস্টিসের সংস্কৃতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে তা আরও খারাপ রূপ ধারণ করবে এবং আইন ব্যবস্থার মর্যাদা চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে মব জাস্টিস বা জনবিচার বন্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি।
সাজেদা আকতার
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।