বন্ধ হোক মেধা পাচার

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মো. আবির হাসান
একটি দেশের দেশীয় শিক্ষায় বেড়ে ওঠা প্রতিভাবান, শিক্ষিত, সুকৌশলী, শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন, ও দক্ষ শিক্ষার্থীরা যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত জীবনযাপন অনুসন্ধানে দেশ ত্যাগ করে, সেটিই মূলত মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেইন নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন হতে পারে, স্বেচ্ছায় মাতৃভূমি ত্যাগ বা বিদেশ গমনের পরও কেন এটিকে পাচার বলা হচ্ছে। একজন ব্যক্তির তার যোগ্যতা, পর্যাপ্ত শিক্ষা ও সৃজনীশক্তি থাকার পরও যখন দেশের অভ্যন্তরে যথোচিত কাজের সুযোগ দৃষ্টিগোচর হয় না, তখনই তার অভিবাসনের মনোভাব সৃষ্টি হয়। সে কারণে এটিকে পাচারই বলা চলে। দেশীয় সিস্টেমের স্বীকার হয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও বুদ্ধিদীপ্ত সেবায় উন্নত দেশকে আরও উজ্জীবিত করে তোলে। যা এদেশের জন্য দুঃখের এবং আফসোসেরও বটে। মূলত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে মেধা পাচার বেশি হয়। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ দক্ষ ও উদ্ভাবনী জনশক্তি। কিন্তু আফসোসের বিষয়, দেশ থেকে এই বিপুল পরিমাণ দক্ষ ও উদ্ভাবনী শক্তিধর শিক্ষার্থী অন্য দেশকে সেবা দিতে পাড়ি জমাচ্ছে। বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ, সেহেতু এদেশ থেকে মেধা পাচার হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মেধা পাচারের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ব্যয়ও বেড়ে যায়। কেননা দেশ থেকে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয়বাবদ খরচ হয় ৫-১৫ লাখ টাকার মতো, কিংবা তারও বেশি। জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের ৮ম দেশ, যার জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। জনবহুল এদেশে, ব্যানবেইসের তথ্যমতে দেশে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৭৭৮ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২ কোটি ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীই উন্নত ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বেছে নিচ্ছে বিশ্বের উন্নত দেশসমূহকে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড উলেস্নখযোগ্য। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদেরই পছন্দের তালিকায় এসব দেশ। মেধা পাচারের মূলে রয়েছে কিছুসংখ্যক তাৎপর্যবহ কারণ। তার মধ্যে গবেষণাবান্ধব শিক্ষাকেন্দ্রের অভাব, উচ্চশিক্ষায় রাজনীতি, পড়াশোনা শেষে চাকরির অনিশ্চয়তা, সরকারি চাকরিতে ঘুষ, দুর্নীতি, দেশীয় চাকরি না পাওয়ার হতাশা। এ ছাড়া যথাযথ গাইডলাইনের অভাব অন্যতম। শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী করে তোলার পেছনে এ বিষয়গুলো জড়িত। সদ্য অনার্সে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থীর কাছে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?' উত্তরে সে নিশ্চয় বলবে, পড়াশোনা শেষ করে, ভালো মানের কোনো সরকারি চাকরি করা। কিন্তু এই একই প্রশ্ন যদি অনার্স ৪র্থ বর্ষ কিংবা মাস্টার্সের শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে উত্তর কি হবে? এ সময় পরিপূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক একজন শিক্ষার্থীর জবাব কি হতে পারে? এত বছর নিজের মেধাশক্তি ও বাবা-মা'র কষ্টার্জিত টাকায় পড়াশোনা শেষ করার পর, দেশের চাকরির বাজারে যখন নিজের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা পরিলক্ষিত হয়, তখন বুকভরা হতাশা এসে গ্রাস করে নেয়। তখন দেশের অভ্যন্তরে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা পরিবর্তিত হয়। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার 'গেস্নাবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস'-এর প্রতিবেদন বলছে ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন ৮ হাজার ৫২৪ শিক্ষার্থী। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, গত এক বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৫৮৬, কানাডায় ৫ হাজার ৮৩৫, জার্মানিতে ৫ হাজার ৪৬, অস্ট্রেলিয়ায় ৪ হাজার ৯৮৭, জাপানে ২ হাজার ৮০২ এবং ভারতে গেছেন ২ হাজার ৬০৬ শিক্ষার্থী। একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে, অপরদিকে বাড়ছে বেকারত্ব ও অভিবাসন প্রক্রিয়া। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও, নেই কোনো ভালো মানের শিক্ষাকেন্দ্র। নেই গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, নেই পড়াশোনার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ। উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের এই বেহাল দশা শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমনে উদ্বুদ্ধ করছে। এবার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশের কথা বলতে গেলে নানা সমস্যা দৃশ্যমান হয়। এর মধ্যে আবাসন সংক্রান্ত সমস্যা ও ক্যাম্পাসের হলগুলোয় পরিমিত পুষ্টিকর খাবারের ব্যাপক সমস্যা বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় গণরুমের প্রভাব দেখা যায়। গাদাগাদি করে হিসাব বহির্ভূতভাবে শিক্ষার্থীরা পড়াশনার সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ফলে শিক্ষার্থীরা নানা রোগের সম্মুখীন হয়। এতে পড়াশোনার পরিবেশও হুমকির মুখে পড়ে। মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এরপর রয়েছে হলের খাবার। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় খাবারে নূ্যনতম পুষ্টিগুণও থাকে না, কোনো কোনো দিন দেখা যায় তরকারির মধ্যে পাওয়া গেছে টিকটিকির বিষ্ঠা, আস্ত পোকামাকড়। এসব কারণের পাশাপাশি রয়েছে লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজনীয় বই ও সিটের অভাব। যেসব বিষয়াদি একটি শিক্ষার্থীকে মেধা বিকাশের উচ্চ আসনে নিয়ে যাবে সে জায়গাতেই নানা সমস্যা। এসব সমস্যাও শিক্ষর্থীদের দেশীয় শিক্ষার সংস্কৃতির ওপর বিরূপ মনোভাব তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে এবং বিদেশমুখী হতে অনুপ্রেরণা জোগায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এরূপ সমস্যা মোকাবিলা করে দেশের মেধা দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারলে দেশের উন্নতির পথ সহজতর হবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা কর্মসংস্থানের তুলনায় অধিক হয়। কাজেই দেশের মধ্যে একটা ঘিচিমিচি পরিবেশের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। চাকরিপ্রত্যাশীরা কর্মসংস্থানের অভাব টের পেয়ে বিদেশমুখী হচ্ছে। সুতরাং দেশ ও জনগণের কল্যাণে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান যাতে গড়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে সরকারের জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দেশের মেধাবীদের দেশকে সমৃদ্ধকরণে যাতে ব্যবহার করা যায় সেদিকে সুনজর প্রয়োজন। আসলে দেশ তাদের কি দিতে ব্যর্থ, যার ফলে দেশ ছাড়তে এত উদ্দীপনা, উদ্বেগ! শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষিত কোনো দেশ তথা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে এটা সুষ্পষ্ট হয়, ঠিক কি কি কি আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অভাব। এর মধ্যে রয়েছে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। এ শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে গবেষণা কাজের অগাধ সুযোগ, রয়েছে গবেষণায় যথেষ্ট সরকারি বিনিয়োগ। এ ছাড়া একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নানা পেশার জন্যও দক্ষ করে তোলা হয়। আছে পর্যাপ্ত ফান্ডিং ব্যবস্থা। এসব ফান্ডিং শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ও স্বাস্থ্য খাতে নিখুঁতভাবে ব্যয় হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের একটা নির্দিষ্ট ভাতা প্রদান করে থাকে। এসব সুযোগ-সুবিধা ও সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের খোঁজ যে কোনো শিক্ষার্থীকেই আকর্ষণ করবে। যদি এসব সুযোগ বাংলাদেশের শিক্ষাকেন্দ্রে ক্রমে ক্রমে প্রচলিত হয়, তাহলে মেধা পাচার রোধ ত্বরান্বিত হবে। মো. আবির হাসান শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়