গণতন্ত্রকে বিপদমুক্ত করতে হবে

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শেখ সালাহ্‌উদ্দিন আহমেদ
ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানে দ্বিতীয় বিজয় অর্জনের দেড় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধারের ঐতিহাসিক নতুন সূচনা হয়েছে লাল-সবুজের দেশে। বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কঠিন কাজটি করছে। দেড় দশকের অনিয়ম-অনাচার, দুর্নীতি-দুঃশাসনে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে গেছে। আইন, বিচার, প্রশাসনে দলীয়করণ ও চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে মেরুদন্ড ভেঙে গেছে গণতন্ত্রের এই তিন স্তম্ভের। গণতন্ত্র পরিণত হয়েছিল স্বৈরাচারের পরিবারতন্ত্রে। অন্তত তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষের ভোট দেওয়ার দরকার হয়নি। জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারই পুনর্র্নিবাচিত হয়ে সদম্ভে দেশ শাসন করতে থেকেছে। লুটপাট, অর্থ পাচারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল দেশ। প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করছে সরকার। খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে এগুলোর। দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্রকে বিপদ মুক্ত করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই জোর দিয়ে উচ্চারণ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বলেছেন, দেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদ মুক্ত নয়। কোনো অপশক্তি যেন গণ-অভু্যত্থানের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন এবং অর্জিত সাফল্যের ধারা নস্যাৎ করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। দেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে- ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। ধর্ম যার যার নিরাপত্তা সবার। ধর্মের পরিচয়ে কেউ এ দেশে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নয়। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভেদ-হিংসা ছড়ায়, তারা নিজ নিজ ধর্মেরই বিরুদ্ধাচরণ করে। পৃথিবীর কোনো ধর্মে হিংস্রতার স্থান নেই। পরমতসহিষ্ণুতা সব ধর্মের শিক্ষা; গণতন্ত্রেরও। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটালেই বিচু্যতি। ওতপেতে আছে তৃতীয় পক্ষ। বিপস্নবে অর্জিত বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার মতলবে নানাভাবে পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা এখনো চলছে। এই চেষ্টা মোকাবিলা করে গণতন্ত্র ঝুঁকিমুক্ত ও সুসংহত করাই এখন জরুরি কর্তব্য। বাংলাদেশে নব্বইয়ের গণ-অভু্যত্থানের পর বাজার অর্থনীতির পথে যাত্রা শুরু হয় সরকারিভাবে। এরপর থেকেই দ্রম্নতগতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। দেশের শিল্প-কলকারখানায় এই মুহূর্তে সিংহভাগ মানুষ কর্মরত। এক সময় কাঁচা পাট ও চা ছিল দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। এখন সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পপণ্য রপ্তানিতে। বিগত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী অপশাসনে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কেও জিম্মি করা হয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের বিজয় সে জিম্মি অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দিয়েছে। তবে পতিত স্বৈরাচারের চররা ব্যবসা খাতে অশান্তি সৃষ্টি করছে পরিকল্পিতভাবে। দেশের অর্থনীতিকে মন্দাদশায় নিতে কলকারখানায় হামলা ও ভাঙচুরের যে লাগাতার ঘটনা ঘটেছে, তা ঠেকাতে সরকার ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। এমনই একটি ঘটনা হচ্ছে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া। এটি নানা দিক থেকেই একটি গুরুতর অপরাধ। কিন্তু এরপরও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে দেশে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে আমাদের। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন এক যুবক। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ওই ব্যক্তির নাম তোফাজ্জল। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন বলে জানিয়েছে পরিবার। তোফাজ্জলকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ফোন করে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করা হয় বলেও জানিয়েছে তার পরিবার। এ ঘটনাকে অমানবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত উলেস্নখ করে দুঃখ প্রকাশ করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। ওদিকে ওই একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে গত্যা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় দেখতে পেয়ে তাকে পিটুনি দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে কিছু শিক্ষার্থী উপস্থিাত হলে অন্যরা আরও বেশি মারমুখী হন। এ সময় শিক্ষার্থীরা তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অফিসে নিয়ে যান। সাবেক শিক্ষার্থী হওয়ায় প্রক্টরিয়াল বডি পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ প্রায় তিন ঘণ্টা পর প্রক্টর অফিসে আসে। এরই মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী চলে এলে প্রক্টরিয়াল টিম কয়েকবার চেষ্টা করেও তাদের আটকাতে ব্যর্থ হয়। পরে রাত সোয়া ৮টার দিকে পুলিশ এলে শামীমকে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার মৃতু্যর খবর শোনা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার এ ঘটনায় আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে জাবি কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় তো কেউ ঘাতক, হন্তারক, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ বা দাগি অপরাধী হিসেবে ভর্তি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাদের অনেকেই হন্তারক, নৃশংস খুনি বা ঘৃণ্য অপরাধী হয়ে ওঠে। তাহলে কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাতক হওয়ার, চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ হওয়ার প্রশিক্ষণ হয়? কিন্তু কেন? আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো স্বায়ত্তশাসিত। তাহলে কি আমাদের স্বায়ত্তশাসন পরিচালনায় বড় রকমের গলদ রয়েছে, যা অপরাধী তৈরিতে সহায়তা করছে? দেশে গত দুই মাসে ৩৫ জনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, সামাজিক অস্থিরতার কারণে গণপিটুনিতে মৃতু্যর ঘটনা বেড়ে চলছে। তুচ্ছ কারণে মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। গণপিটুনির ঘটনা ঘটা মানেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া। দেশের কোনো নাগরিক নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না। এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল এই হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। এই মন্দ প্রবণতাটি রোধ করতে হবে। যারা এ ধরনের হত্যাকান্ডে জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, সেটি আমরা কেউ চাই না। তাই এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। যারা পিটিয়ে মানুষ হত্যা করছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পিটিয়ে মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। বিগত দেড় যুগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছিল একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের আখড়া হিসেবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভু্যত্থানের ফলে সে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত হলেও নতুন দুর্বৃত্তরা যে শূন্যস্থান পূরণে থাবা বিস্তারের চেষ্টা করছে ঢাবি ও জাবির দুই হত্যাকান্ড তারই প্রমাণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা 'মব জাস্টিস'-এ জড়িত অপরাধীদের শাস্তি দাবি করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য দলীয় রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আমরা আশা করব, মব জাস্টিসে জড়িতদের দ্রম্নত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। শেখ সালাহ্‌উদ্দিন আহমেদ অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট