সম্প্রতি (১৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেনকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনার পরে মব জাস্টিস বিষয়টি বেশ নাড়া দিয়ে উঠেছে সবাইকেই। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ গণপিটুনির শিকার হয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বর্তমানে মব জাস্টিস বিষয়টি যেন নতুন বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে কারও কারও কাছে! নিজেদের বিচারক ভাবতে বেশ দাম্ভিকতাও কাজ করছে। কিন্তু একই সঙ্গে নিজেদের মানুষ হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে অগোচরেই।
শুধু সাম্প্রতিক সময়েই নয়, এর পূর্বেও মব জাস্টিস এবং লিঞ্চিংয়ের বহু ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিনবাজারে 'ডাকাত' সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছিল ৬ ছাত্রকে। ২০১৯ সালে বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামের এক মা'কে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। সম্প্রতি এমন আরও একটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতে, গত ৭ সেপ্টেম্বর আব্দুলস্নাহ আল মাসুদ নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তানে বস্নাসফেমির অপরাধে মাশাল খানকে মব লিঞ্চিংয়ের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল। সঙ্গে গোমাংশ থাকার সন্দেহে বা গোহত্যার জন্য ভারতে মব লিঞ্চিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে হত্যা করা হয়। অবশ্য মব ক্ষেপলেই যে সব সময় লিঞ্চিং বা হত্যা হবে তা কিন্তু নয়, অনেক সময় শুধু গণপিটুনি দেওয়া হয় বা ভাঙচুর করা হয়। আবার অনেক সময় কিছু ক্ষেত্রে লিঞ্চিং করতে সমর্থন জানানো হয় যেমন- ধর্ষক, চোর, অপরাধীদের গণপিটুনি দেওয়াতে। বাংলাদেশে ওই ঘটনাগুলোতে মব লিঞ্চিংয়ের সংখ্যাটি আমাদের মনে কিঞ্চিৎ হলেও প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটায় মব জাস্টিস বা মব লিঞ্চিং বিষয়টি কি এবং কেনই এমনটি ঘটে থাকে!
উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার, মব জাস্টিস বা মব রুল বা মবোক্রেসি বা ওখলোক্রেসি একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ। মব (সড়ন) অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস (ঔঁংঃরপব) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। 'মব জাস্টিস' অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। 'মব জাস্টিস' (গড়ন ঔঁংঃরপব) বলতে জনতার হাতে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বোঝানো হয়। এ ধরনের ঘটনায় যদি কেউ মারা যায় বা জনতার গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে তাকে লিঞ্চিং (ষুহপযরহম) বলে। এর অর্থ বিচার বহির্ভূত হত্যা।
এছাড়া, জনতা দ্বারা বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর সবকিছুই মব জাস্টিসের অংশ। সাধারণত, উত্তেজিত জনতা কোনো অপরাধ বা অপরাধীকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় বিচার না করে নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে- যা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত।
এখন আলোচনা করা যাক মব জাস্টিস কেন হয়?
মব জাস্টিস এবং পরবর্তী সময়ে মব লিঞ্চিং বিষয়টি উত্তেজিত পরিবেশে আবেগী জনতার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেখানে অনেকে গুজুবের বশবর্তী হয়ে উত্তেজনা প্রবণতায় আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। মূলত অব্যবস্থাপনা, আইনের প্রতি অসন্তোষ, ক্ষোভ, আইন প্রয়োগের অভাব, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব, বৈষম্য, বিচার বিভাগের দুর্বলতা, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ার ফলে ঘটে থাকে। সমাজ মনোবিজ্ঞানে জনতা বা ক্রাউড একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যারা মব জাস্টিসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। হার্বার্ট বস্নুমার তার 'কালেক্টিভ বেহাভিওর' বইতে জনতাকে চার ভাগে ভাগ করেছেন:
১. আকস্মিক জনতা, ২. রীতিগত জনতা, ৩. সক্রিয় জনতা এবং ৪. অভিব্যক্তিপূর্ণ জনতা।
সোশ্যাল সাইকোলজি বইতে রোগার ব্রাউন জনতাকে 'সক্রিয় জনতা' ও 'নিষ্ক্রিয় জনতা' এই দুই ভাগে ভাগ করেন। ব্রাউন সক্রিয় জনতা বলতে উচ্ছৃঙ্খল জনতা বা মব এবং নিষ্ক্রিয় জনতা বলতে শ্রোতৃবর্গ বা অডিয়েন্স বুঝিয়েছেন। লে বঁ, মার্টিন, আলপোর্ট, মুজাফফর শেরীফ, সার্জেন্ট উইলিয়ামসন প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীরা জনতার ওপর বিস্তারিত আলোচনায় জনতার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তার মধ্য উলেস্নখযোগ্য আবেগপ্রবণতা, দায়িত্ববোধের অবনতি, ক্ষমতাবোধ, অনামিত্ববোধ। তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় যুক্ত ছাত্রদের আটক করা হলে তাদের মধ্য একজন ছাত্র বলছিলেন, তিনি আবেগের বশে মেরেছেন।
এরূপ উক্তিতে যে আবেগগুলোর কথা বলা হয়েছে, তা কীভাবে এবং কত নৃশংসভাবে একজনের প্রাণনাশের কারণ হয়ে ওঠে- যা আমাদের ভাবনারও অতীত।
মব জাস্টিসের বিষয়গুলো ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে প্রবলভাবে দৃশ্যমান হতে শুরু করে, প্রতিপক্ষের বাড়ি পোড়ানো, একে অন্যের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ, ধর্মীয় উপাসনালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা, শিক্ষকদের হেনস্তা করা, জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর বিষয়গুলো উলেস্নখযোগ্য। সব ঘটনাগুলোতে যেমন দোষী ব্যক্তি রয়েছেন তেমনই অনেকে নির্দোষ ব্যক্তিও ভুক্তভোগী- যা মোটেও কাম্য নয়। নিজেরা বিচারকের আসনে বসে ভূমিকা পালন না করে আবেগ তাড়িত না হয়ে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়গুলো সমাধান করা শ্রেয়। কিন্তু আমাদের মধ্য নিজেদের প্রকাশ করার ইচ্ছায় কেন কিছু যাচাই-বাছাই করেই আমরা যে কোনো কাজে উচ্ছৃঙ্খল জনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অন্যকে দমায়ন করে নিজেকে সাহসী ভঙ্গিমায় অবস্থান করানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের আবেগের বশে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মব জাস্টিস কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না, বরং এটি আরও জটিলতা তৈরি করে এবং নিরপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন করে।
যা একজন মানুষের জীবন এবং তাদের পরিবারকে মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে। মৃত ব্যক্তিটি হয়তো তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। তাহলে এই ক্ষেত্রে ওই পরিবারের সঙ্গে কি আমরা অন্যায় করে ফেলছি না? অন্যায় প্রতিরোধ করতে যেয়ে নিজেরা যেন অন্য আরেকটি অন্যায়ের সূচনা না করি। যে কোনো পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপটের কারণ যেমন সব দোষী ব্যক্তি নয়, একইভাবে সব ব্যক্তি নির্দোষও নয়, কিন্তু আমরা যদি আমাদের বিবেচনা বোধের যথাযথ প্রয়োগ না করে আবেগ উত্তেজনার বশীভূত হয়ে কাজ করি, তাহলে নিজেদের মানুষ হিসেবে গণ্য করাও সম্ভব নয়। আমাদের উচিত আইনের শাসনের প্রতি আস্থা রাখা এবং বিচারের প্রক্রিয়াকে সম্মান করা। এক মুহূর্তের রাগ কিংবা উত্তেজনা আমাদের মানুষ থেকে অমানুষে রূপান্তর করতে পারে- যা আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিরোধী। তাই নিজেদের বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত করার পূর্বে, মানবিকতার পরিচয় দিয়ে প্রত্যেককে আগে মানুষ হিসেবে চিন্তা করতে হবে। নিজেদের কর্ম সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। যেন দিন শেষে নিজেকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধার সৃষ্টি না হয়।
রোকাইয়া তিথি :নবীন লেখক