সময়ের সমষ্টিই জীবন

পৃথিবীর সব মানুষের কাছে সময় সবচেয়ে সম্মানিত বস্তু। তাই সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করা প্রতিটি মানুষের ওপর অপরিহার্য। সময়ের সমষ্টিই জীবন। সময়ের অপচয় জীবনে ব্যর্থতা ডেকে আনে।

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মো. জাহিদুল ইসলাম
সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে এককভাবে যে রাজত্ব করে যাচ্ছে তার নাম সময়। সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে সময় নির্ণয়ের পদ্ধতির। এর পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে সময় নির্ণয়ক যন্ত্রেরও। সময় হলো জীবনের অমূল্য এবং অদ্বিতীয় সম্পদ- যার কোনো বিকল্পও নেই। সময় অস্থিতিস্থাপক, সময় ক্ষয়প্রাপ্ত- যা কখনো জমা থাকে না। সময় কখনোই প্রতিস্থাপনযোগ্যও নয়। সময় অতি দ্রম্নত অতিবাহিত হয়। এটি কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের যথার্থ ব্যবহারের মধ্যে এর প্রকৃত সাফল্য নিহিত। সময় একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। বর্তমানকাল প্রতি মুহূর্তে বিগত হচ্ছে এবং অতীতে পরিণত হচ্ছে। আবার ভবিষ্যতের ভান্ডার থেকে প্রতিটি মুহূর্ত বের হয়ে এসে বর্তমানে পরিণত হচ্ছে এবং বর্তমান থেকে অতীতের না ফেরার অতল গহ্বরে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। মানবজাতি সৃষ্টির শুরু থেকেই সময়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার সভ্যতা এবং ইতিহাসকে। সময়ের আবিষ্কার হয়নি বরং এই সময়কেই আবিষ্কার করা হয়েছে। সময় একটি প্রাকৃতিক ঘটনা- যা প্রাচীনকাল থেকে মানুষ গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে। মানুষ সর্বপ্রথম সময়ের ধারণা মূলত দিন-রাতের নিয়মিত আবর্তন থেকে বের করে। পৃথিবীর নিজ অক্ষে একটি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। যে সময়টি একদিন সূর্যোদয় থেকে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের দিকে থাকে সে অংশে দিন এবং বিপরীত অংশে রাত হয়। প্রাচীন মানুষ প্রকৃতির এই নিয়মিত পরিবর্তনকে একটি আদর্শ সময় মান হিসেবে বিবেচনা করত। পরবর্তী সময়ে এই সময়কেই বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে গণনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সময়ের হিসাব রাখত। একটা সময় ছিল যখন শুধু সূর্যের অবস্থান দেখেই মানুষ ধারণা লাভ করত সময় সম্পর্কে। পরবর্তী সময়ে মানুষ সূর্যের উদয় ও অস্ত, চাঁদের পূর্ণিমা ও অমাবস্যা, ঋতু পরিবর্তন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে সময়ের হিসাব রাখত। এমনকি মানুষের তৈরি প্রথম যান্ত্রিক ঘড়িতেও কাজে লাগানো হয়েছিল সূর্যের সময় ভিত্তিক অবস্থানের সূত্রকে ভিত্তি করে। এই সময়ের হাত ধরেই মানুষের এই এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হতেই কালে কালে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়েই আবিষ্কার হয়েছে সময় দেখার যন্ত্র অর্থাৎ ঘড়ি। ঘড়ি একটি যন্ত্র- যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একটি শব্দ বা প্রতীক তৈরি করে। ঘড়ির আবিষ্কারের ফলে সময়ের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে আরও নির্ভুলতা আসে। ঘড়ি নামে পরিচিত যন্ত্র দিয়ে সময় পরিমাপ করা হয়। ঘড়ি মূলত এমন একটি যন্ত্র- যা সময় পরিমাপ রাখা এবং নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। ঘড়ি হলো প্রাচীনতম মানব আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম অত্যাবশ্যকীয় আবিষ্কার। মূলত প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ যখন সভ্যতার ছোঁয়া পেতে শুরু করেছিল ঠিক তখন থেকেই মানুষ সময়ের গুরুত্ব এবং তা সঠিকভাবে নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে। ঠিক এ কারণেই তখন থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞানী, জ্যোতিষী এবং সমাজ প্রধান সবাই মিলিতভাবে সময় সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। সময় নির্ণয় পদ্ধতি নিয়ে প্রাচীন মিশর, প্রাচীন গ্রিস এবং প্রাচীন রোম সভ্যতার অনেক পুরাতন নিদর্শন এবং দলিল পাওয়া গেছে। প্রাচীন মিশরে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সূর্যঘড়ি আবিষ্কৃত হয়। সূর্যঘড়ি একটি সরল যন্ত্র- যা সূর্যের আলোর পথের ওপর ভিত্তি করে সময়ের হিসাব রাখে। সূর্যঘড়ির আবিষ্কারের ফলে সময়ের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হয়। অপরদিকে, প্রাচীন গ্রিসে ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জলঘড়ি আবিষ্কৃত হয়। জলঘড়ি একটি যন্ত্র- যা জলের প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে সময়ের হিসাব রাখে। জলঘড়ির আবিষ্কারের ফলে সময়ের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে আরও সুবিধা হয়। মূলত মধ্যযুগ থেকেই নির্ভুলভাবে সময় পরিমাপ করার জন্য এক এক ধরনের ঘড়ির যন্ত্র আবিষ্কৃত হতে থাকে। তবে সময় গণনা প্রাচীনকাল থেকেই শুরু হয়েছে। মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সময়ের হিসাব রাখত। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সময় গণনার জন্য বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভুল ও সহজ যন্ত্র হলো বৈদ্যুতিক ঘড়ি। আধুনিক যুগে বৈদ্যুতিক ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়। বৈদ্যুতিক ঘড়ি এমন একটি যন্ত্র- যা বৈদ্যুতিক প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে সময়ের হিসাব রাখে। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ শৈশবকাল থেকেই ২৪ ঘণ্টায় ১ দিন, ৬০ মিনিটে ১ ঘণ্টা এবং ৬০ সেকেন্ডে ১ মিনিট এভাবে হিসাব করেই অভ্যস্ত। সময় গণনার এই পদ্ধতিটি চলে আসছে প্রায় ১৫৫০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে। তৎকালীন সময়ে প্রাচীন মিশরীয়রা পৃথিবীতে অবস্থিত বাকি সভ্যতার থেকে জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে অনেকটাই উন্নত এবং অগ্রগামী ছিল। তখনকার অ্যাস্ট্রোনমাসদের কাছে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণের বিষয়টি জানা ছিল। সে সময় তারা প্রাকৃতিকভাবে ধারণা থেকে প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন যে প্রথমে দিন হচ্ছে তারপর রাত। এরপর আবারও পর্যায়ক্রমে দিন হচ্ছে তারপর রাত। যেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এই প্রাকৃতিক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তাই তখন থেকেই তারা এগুলোকে অনেক ভাগে ভাগ করে গণনার কথা ভাবেতে শুরু করে। সেই সময়ে গণনা করার জন্য কোনো যন্ত্র না ছিল না। তাই তারা কোনো কিছু গণনা করার জন্য গণনার মানদন্ড হিসেবে হাতের আঙুলের ব্যবহার করতেন। তারা হাতের ১০টি আঙুল গুণে সবকিছু হিসাব করতেন। প্রাচীন মিশরীয়রা এক দিনকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করে হিসাব করতেন। যেমন ১২ ভাগ দিনের ও ১২ ভাগ রাতের। এই দুই ভাগ মিলিয়ে হয় ২৪ আর এভাবেই আসে ২৪ ঘণ্টার ধারণাটি। মিশরীয়রা যেখানে গণনার ক্ষেত্রে ১২ কে বেজ হিসেবে ধরতেন সেখানে আবার উল্টো দিকে প্রাচীন মিশরীর অন্য সভ্যতারা ১২-এর পরিবর্তে ১০-কে ভিত্তি হিসেবে ধরতেন। অপরদিকে অন্য আরও একটি প্রাচীন সভ্যতা ছিল যারা ৬০-কে গণনার কাজে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতেন। যা তারা ম্যাথমেটিক্স ও আস্ট্রোনমিতেও ব্যবহার করতেন। তাদের ধারণা অনুযায়ী ৩৬০ ডিগ্রিতে একটি পূর্ণ বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। আর ৬০-কে ছয় বার যোগ করলে ৩৬০ হয়। এদিকে আবার যেহেতু পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে সেক্ষেত্রে যদি পৃথিবী দিনে ১ ডিগ্রি ঘোরে তবে সূর্যের চারদিকে সম্পূর্ণ এক চক্কর ঘুরতে সময় লাগবে ৩৬০ দিন- যা আনুমানিক ৩৬৫ দিনের সমান। আবার ৬০ এমন একটি সংখ্যা যেটি ১, ২, ৩, ৪, সব ধরনের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায়। মূলত এসব দিক বিচার করেই তারা গণনার সব ক্ষেত্রেই ১২ আর ১২ ঘণ্টার প্রতিটি ভাগকে ৬০ দ্বারা ভাগ করে। সময়কে যখন থেকে নির্ভুলভাবে গণনার কাজ শুরু করা হয় তখন প্রাচীন যুগের তৈরি করা এই নীতিগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এজন্যই এক দিনে ২৪ ঘণ্টা, এক ঘণ্টায় ৬০ মিনিট এবং ১ মিনিটে ৬০ সেকেন্ড হিসাব করা হয়। মহাবিশ্বই মূলত সবকিছুর ধারণ। এই মহাবিশ্বের মধ্যেই আমাদের এই পৃথিবীসহ সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছু রয়েছে। এর মধ্যেই রয়েছে সব স্থান এবং সব পদার্থ এবং শক্তি- যা মহাকাশে রয়েছে। ঘড়ির কাঁটা ঘোরা এমনকি সময়ও এই মহাবিশ্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই মহাবিশ্ব আমাদের নিজেদেরও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। মহাবিশ্বের সময় শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর মধ্য দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব ধারণাটি গঠিত হওয়ার পাশাপাশি তার সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশ ধারণাটিও গঠিত হয়। বৈজ্ঞানিক তথ্য মতে ১৫ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের এ মহাবিশ্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। প্রায় শূন্য থেকে মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে এক মহাবিস্ফোরণ ঘটল। সেই 'বিগ ব্যাং'-এর মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকার ভরবিশিষ্ট ভীষণ উত্তপ্ত একটি বিন্দু দুই বিলিয়ন কিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো। এভাবেই সেই 'বিগ ব্যাং'-এর সময় থেকে এলো মহাবিশ্ব এবং সেটি প্রতিনিয়তই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। সময়ের বহতা নদীর মতো। নদীর স্রোত যেমন উজান থেকে ভাটির দিকে বয়ে চলে যায় তেমনি সময়ের স্রোত অতীত থেকে বর্তমানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে বয়ে যায়। জন্ম থেকে মৃতুু পর্যন্ত সময়ের এই একমুখী স্রোতে আমরা প্রতিনিয়ত ভেসে চলেছি। সময়ের স্রোত এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। আমাদের যাপিত জীবন থেকে রুটিন মতো প্রতিদিন ৮৬ হাজার ৪০০ সেকেন্ড অতিবাহিত হচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে আমরা খুবই অমনোযোগী। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। লক্ষ্যহীন মানুষ সময় অপচয় করে। যাদের জীবনের লক্ষ্য আছে তারা সময়কে কাজে লাগায়। সময়ের প্রতি গুরুত্বহীন ব্যক্তি কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। মানব জীবনের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সময়। পৃথিবীর সফল মানুষের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা সময়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। পৃথিবীর কোনো শক্তিই সময়ের গতিশীলতাকে রোধ করতে পারে না। সময় কখনো থামতে জানে না। সে তার আপন গতিতে সদা চলমান। সময় কখনো ক্লান্ত হয় না; তাই তার বিশ্রামেরও প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীর সব মানুষের কাছে সময় সবচেয়ে সম্মানিত বস্তু। তাই সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করা প্রতিটি মানুষের ওপর অপরিহার্য। সময়ের সমষ্টিই জীবন। সময়ের অপচয় জীবনে ব্যর্থতা ডেকে আনে। মো. জাহিদুল ইসলাম :কলাম লেখক