সত্যের কবি নজরুল এভাবে বলেছিলেন,
'অসত্য যত রহিল পড়িয়া, সত্য যে গেল চ'লে, বীরের মতন মরণ-কারারে চরণের তলে দ'লে' অর্থাৎ মিথ্যা এবং ভ্রান্ত ধারণাগুলো টিকে থাকে, কিন্তু সত্য ত্যাগ করে চলে যায়। সত্যকে দমন করা হয়, কিন্তু তা বীরের মতোই মর্যাদাপূর্ণভাবে নত হয়ে যায়, যা দমন করেও তার মহত্ত্বকে ছোট করা যায় না। সত্যকে সাময়িকভাবে অবদমিত করা হলেও তার গৌরব সবসময় থাকে। যখন মানুষের কণ্ঠরোধ করে সত্য দমিয়ে রাখতে চায়, তখন যেকোনো আন্দোলন -সংগ্রাম চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে ধাবিত হয়। সদ্য-বিদায়ী স্বৈরশাসক হাসিনা, দেশে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে সরকারের সমালোচনা সহ্য করা হয় না। গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সত্য প্রকাশের ওপর ছিল খড়্গহস্ত। সৃষ্টি করেছে 'ধায়নাঘর' নামক অদৃশ্য কারাগারের। সহযোগিতায় ছিল লেবাসধারী, অতি-দলবাজ হিসেবে চিহ্নিত কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। যেখানে তাদের দায়িত্ব ছিল প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দল-মত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে বৈষম্যহীনভাবে সেবা প্রদান করা, যেটি সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। কিন্তু তাদের অনেকেই দলীয় ভূমিকায় দেখা গেছে। সত্যকে ক্ষণিকের জন্য মিথ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু চিরদিনের জন্য ঢেকে দেওয়া যায় না। সে প্রকৃতির ইচ্ছায় প্রকাশিত হয়। আজ অপরাজনীতির সব হালচাল প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
এ দেশের এমপি-মন্ত্রী রাতারাতি হয়ে যায় আঙুল ফুলে কলাগাছ। জনগণের সেবক না হয়ে, হয়ে যায় ভক্ষক। একেকজন বনে যায় শতকোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন সহিংসতায় নেতৃত্ব দিতেও দেখা যায়। একজন সৎ নেতার আদর্শ কখনো এমন সস্তা হয় না। একজন নেতা হবেন ডাউন টু আর্থ অমায়িক ও সৎ। তার মধ্যে থাকবে সম্মোহনী ক্ষমতা অর্থাৎ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জনমনে আনবে ম্যাজিক্যাল পরিবর্তন। সবার কাছে হয়ে উঠবে অনুকরণীয়। কিন্তু এর উল্টোটাই দেখা যায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সততা একটি অতি প্রয়োজনীয়, তবে অনেকাংশে দুর্লভ গুণ হিসেবে দেখা যায়। আমাদের দেশের রাজনীতি, যেটি প্রায়শই দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগে জর্জরিত, সেখানে একজন সৎ রাজনীতিবিদকে পাওয়া যেন মরুর বুকে এক ফোঁটা পানির মতো।
সততার ভিন্নরকম শক্তি আছে- এ কথা আমরা সমাজ, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে শিখি। কিন্তু রাজনীতিতে এর প্রতিফলন দেখা যাওয়া একটু দুরূহ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে, যারা নীতির পথে ছিলেন, তাদের জনসমর্থন অর্জন করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তার জনপ্রিয়তা এবং জননেতৃত্বের মূল চালিকাশক্তি ছিল তার সততা এবং জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা। তার নিষ্ঠা ও ত্যাগের প্রতি মানুষের আস্থা ছিল অবিচল। সেই সততা তাকে দেশকে স্বাধীন করার মতো বৃহত্তর আন্দোলন পরিচালনা করার শক্তি যুগিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সততা কেমনভাবে প্রভাব ফেলে? একজন সৎ নেতার উদাহরণ আমাদের কল্পনায় থাকলেও বাস্তব জীবনে তা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। বর্তমান সময়, যখন স্বার্থপর রাজনীতি ও লোভ নৈতিক মূল্যবোধের ওপর প্রাধান্য পায়, তখন একজন সৎ রাজনীতিবিদ ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু যখনই কেউ এই দুঃসাধ্য কাজটি করতে সক্ষম হন, তখন তা বিপস্নবী প্রভাব ফেলে। জনগণের আস্থা ও সমর্থন এমন একজন নেতার প্রতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বৃদ্ধি পায়, যিনি নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেন।
আমাদের দেশেও কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যারা সততার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তাদের কর্মকান্ড প্রমাণ করে যে, সৎ রাজনীতি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। যখন নেতারা ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে জনগণের স্বার্থে কাজ করেন, তখনই জনগণ তার প্রকৃত সুফল ভোগ করতে পারে।
সততার শক্তি সময়ের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। একজন সৎ নেতার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তার সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিবেশকে নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও উদাহরণ স্থাপন করে। আজকের সৎ রাজনীতি আগামীকালের সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের ভিত্তি গড়ে দেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সততার পুনরুত্থান কেবল আদর্শ নয়, বরং একান্ত প্রয়োজন। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বজনপ্রীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সততা, নৈতিকতা এবং জনসেবাকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে হবে। সততার ভিন্নরকম শক্তি আছে-এটি মানুষকে স্বপ্ন দেখায় এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে। বাংলাদেশের জন্যও এটি কোনো স্বপ্ন নয়, বরং এক বাস্তবতা হওয়া উচিত, যা আমাদের রাজনীতির প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হবে।
ছাদেক হোছাইন
ঢাকা
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়