শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

তোফাজ্জল তুমি ক্ষমা কর!

তোমরা জাতির অহংকার না হয়ে কলঙ্ক তৈরি করছ। আমি লজ্জিত, একজন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
গোপাল অধিকারী
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
তোফাজ্জল তুমি ক্ষমা কর!

বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে মৃতু্য হয়েছে তোফাজ্জলের। কি মর্মান্তিক মৃতু্য! মর্মান্তিক পিটুনির সেই ভিডিওটি যতবার দেখছি ততবার আমার ক্রোধ জেগেছে ওই অমানুষগুলোর বিরুদ্ধে। একটা মানুষ যখন অসহায়ত্ববোধ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারপরও তার হাতের মধ্যে লাঠি দিয়ে দুই পাশে দু'জন দাঁড়িয়ে শাস্তি দিতে হলে কতটা নরপিচাশ হতে হয় আমার জানা নেই। ভিডিওটি দেখে আমার মনে হয়েছে এদের মধ্যে কি একটাও মানবিক মানুষ ছিল না যে, তাকে বাঁচিয়ে আইনের আওতায় নিয়ে যাবে? দেশে কি কোনো আইনকানুন নেই? আমি মানুষ হিসেবে লজ্জা বোধ করছি। একটা পশুকেও কেউ এমনভাবে মারতে পারে কিনা আমার জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানে যদি এমন ঘটনা ঘটতে পারে তবে তারা আর যাই হোক মানবিক মানুষ নয়, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

হল সূত্রে জানা যায়, মূলত মোবাইল চুরিকে কেন্দ্র করে ঘটে এ ঘটনা। দুপুরে হলের মাঠে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার ক্রিকেট খেলা চলাকালীন ৬টা মোবাইল চুরি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে খেলা চলাকালীন ৮টার দিকে তোফাজ্জল হলে ঢুকলে তাকে আটক করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের ধারণা, তোফাজ্জলই মোবাইল চুরি করছে। তাকে গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং হালকা মারধর করেন শিক্ষার্থীদের কয়েকজন। পরবর্তী সময়ে তাকে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে আবারো গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন জানার পরেও তাকে ছাড়েননি অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা। প্রেম সংক্রান্ত কারণে মানসিক ভারসাম্য হারান তোফাজ্জল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, সিনিয়র শিক্ষার্থীরা তাদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। নির্যাতন করা শিক্ষার্থীদের সবাই ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থী।

এ সময় গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়। তোফাজ্জলের ভ্রম্ন ও চুল কেটে দেয়। মারধরে তোফাজ্জলের ডান পা এবং বাম পায়ের মাংস খুলে পড়ে যায় তখন। পা বেঁধে শুরু হয় আবারও মার। বুট জুতা পরে এসে তোফাজ্জলের আঙুল মাড়িয়ে ছেঁচে ফেলেন। হাতের আঙুল মাটিতে বিছিয়ে মাড়িয়েছে। তার গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করা হয়। পরে অবস্থা খারাপ দেখে একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাঁচ-ছয়জনের একটি দল তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে রাত ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করলে সটকে পড়েন ওই শিক্ষার্থীরা।

তোফাজ্জলের ফুফাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া বলেছেন, 'রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার বাবাকে একজন ফোন দিয়ে বলেন, তোফাজ্জল চুরি করতে এসে ধরা পড়েছেন- এখন ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার বাবা তার কথা বুঝতে না পেরে তাকে ওই নম্বরটি দেন। সে ওই নম্বরে কল দিলে তার কাছেও একই দাবি করেন। তখন সে তাদের অনুরোধ করে বলে তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন তাকে আপনারা মাইরেন না- তাকে সন্দেহ হলে থানা পুলিশের কাছে দিয়ে দিন। তবুও বিবেককে নাড়া দেইনি নরপিশাচদের।

কী করুণ মৃতু্য ঘটনার জন্ম দিল মেধাবীরা। এসব শিক্ষার্থীরা মোবাইলের জন্য তার বাবা-মাকে হত্যা করবে না তার নিশ্চয়তা কি আমরা দিতে পারি? যারা মধ্যযুগীয় বর্বরতায় অংশ নেয় তারা আর যাই হোক মানবিক হতেই পারে না। তাদের বিচারের আওতায় না আনলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবেই ঘটবে। সুতরাং, এই ঘটনাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। যদিও মৃতু্যর ঘটনায় সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ফজলুল হক হল থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে সংক্ষিপ্ত সমাবেশও করেছেন তারা। বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মারধরের ফলে একজনের মৃতু্য হয়েছে। এসব ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং মানবাধিকারের মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। আমরা অনতিবিলম্বে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছি।

আমি জাতিতে সনাতন ধর্মের তবুও তোফাজ্জলের আলস্নাহর প্রতি আনুগত্যের একটি ভিডিও দেখে তার এমন মৃতু্য মেনে নিতে পারছি না। তোফাজ্জলকে খেতে দেওয়ার দৃশ্যটি রীতিমতো ভাইরাল। একটি পশুকেও খেতে দিলে তার প্রতি যে মায়া-মমতা তৈরি হয় তাকে পরবর্তী সময়ে মারতে গেলেও মন কাঁদে। আর তোমরা মানুষ হয়ে একটি মানুষকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে মৃতু্য নিশ্চিত করলে তোমাদের সন্ত্রাসী বললেও ভুল হবে। তোমরা তো ছাত্র তোমাদের রক্তে এত নেশা কীভাবে হলো? তোফাজ্জলের বাড়ি বরিশালের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে। তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন জানা গেছে। সে খুব ভালো ছাত্রও ছিল। তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই, তবুও তার জন্য প্রাণটা কাঁদে। এর একটাই কারণ মানবিকতা। সব অমানবিকতার বিরুদ্ধে যদি আমাদের প্রাণ কাঁদে তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে বিবেক। আর বিবেক প্রতিষ্ঠিত হলেই সমাজ থেকে দূর হবে সব অমানবিকতা। সংঘটিত এক একটি অপরাধ আমাদের এক একটি দিকে ধাবিত করে। এক সময় মনে হয়েছে জাতি গঠনে মেধাবী প্রয়োজন কিন্তু এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে মনে হয় মেধাবী নয় আগে মানুষ হওয়া প্রয়োজন। ছিঃ! মেধাবী ছিঃ!

তোমরা জাতির অহংকার না হয়ে কলঙ্ক তৈরি করছ। আমি লজ্জিত, একজন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

\হতোফাজ্জল তুমি তাদেরই ক্ষমা কর, যাদের মানবিকতা আছে কিন্তু ওদের কাছে সেখানে অসহায়।

গোপাল অধিকারী : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে