কী হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে?
আবরার হত্যার ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল এবং বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। শিক্ষার্থীরা অবশ্যই রাজনীতি করবে কিন্তু রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়াবে না। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি হতে হবে পরিশীলিত ও আদর্শের, চর দখলের নয়।
প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মাছুম বিলস্নাহ
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন সেই আগের খেলায়ই মেতে আছে! আদব কায়দা শেখানোর নামে রুমে নিয়ে বিভিন্ন কায়দায় টর্চার করা! শেখ হাসিনাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি বলে দে মাইর! ছাত্রলীগের মিছিলে আসতে বিলম্ব হয়েছে লাগা মাইর! কাউকে পছন্দ হচ্ছে না সবার সামনে অমানবিক শাস্তি! অর্থাৎ দেশে কোনো আইন নেই, নিজেরাই যেন আইন। নিজেদের যা ইচ্ছে তাই করবে। কাউকে সন্দেহ হলো ধরে অমানবিক নির্যাতন! এর কোনো পরিবর্তনই কী হবে না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বহু বছর আগে থেকেই কারাগার বানিয়ে রাখা হয়েছে, ভয় ও আতঙ্কের জায়গায় পরিণত করা হয়েছে। এ থেকে জাতিকে মুক্তি দিতেই হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে নব্বই দশকের দিকে কোনো রিকশাওয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলে এমনকি ক্যাম্পাসে যেতে চাইত না। অনেক অনুনয় বিনয় করে কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিত, 'ওখানে খুব ভালো মানুষরা থাকে তো, আমাদের ভাড়া তো দেয়ই না, বরং আমাদের কাছে যা কিছু থাকে তা নিয়ে উল্টো আমাদের লাথি ও ঘুষি মেরে তাড়িয়ে দেয়।' যারা গাড়িতে চলাফেরা করেন তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাড়ি ঢোকাতে সাহস পান না। কারণ কখন কে কি করে ফেলে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখানো তো বিচার নেই। পুরো ক্যাম্পাসই হচ্ছে 'মগের মুলস্নুক, এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরো ক্যাম্পসই 'মবের মুলস্নুক' অর্থাৎ উন্মত্ত জনতার চড়!
\হবিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে যে, ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে চুরি সন্দেহে এক ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে মারধর করে একদল শিক্ষার্থী। যেন পৈশাচিক উলস্নাস! লোকটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এটা কি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাজ? এটা কি সেই শিক্ষার্থী যারা নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে স্বৈরাচারকে দেশ ছাড়া করেছে, দেশের মানুষকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে? এরা কি সেই শিক্ষার্থী যারা দেশের মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে? এরা কি সেই শিক্ষার্থীরা যারা পুরো দেশটাকে কারাগার বানানো হয়েছিল, আয়না ঘর বানানো হয়েছিল সেই জাহান্নাম থেকে মুক্তমনের শিক্ষক, ছাত্র, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে মুক্ত করেছে? নিশ্চয়ই না। তাহলে এরা কারা? এদের অবশ্যই চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে, কোনোভাবে ছাড় দেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় হবে সবচেয়ে উন্মুক্ত জায়গা। মানুষ বিপদে পড়লে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যেতে চায়, আমরা সেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চাই। আমরা কোনোভাবে চাই না ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল বা অমুক দলের দখলে ওমুক হল, ওমুক বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। যদি তাই হয়, তাহলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী, দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী, খেটে খাওয়া মানুষের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার আশায় আসে। তারা মহান আদর্শ শিখতে আসে, কিন্তু ক্যাম্পাসের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, এখানে এসে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক দুষ্ট রাজনীতিতে তাদের জড়াতে হয় না হলে সিট পাওয়া যায় না, ডাইনিং-এ ক্যান্টিনে খাবার খাওয়া যায় না, নিরাপদে ক্যাম্পাসে হাঁটাচলা করা যায় না। পড়াশুনা উধাও, মানসম্মান উধাও! বড় ভাই ছোটভাই সম্পর্ক উধাও! শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক বিষাক্ত! এগুলো তো আমরা আর চাই না। আমাদের শিক্ষকরা বলতেন, তাদের সময়ে কোনো মেয়ে বিপদে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খুঁজতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খুঁজতেন যে সেখানে তারা নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবেন। আর এখন মেয়েরা ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে যায় না, পারতপক্ষে ক্যাম্পাস ও হল থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে। কারণ তারা জানে যে এখানে ধর্ষণের 'সেঞ্চুরি' করা হয়। এই কালচার তো পরিবর্তন করতেই হবে- তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান্ত্রিক মানুষ তৈরি করে লাভ কী? মানবতাবিহীন মানুষ তৈরি করে লাভ কী? সন্ত্রাসী বানানোর জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় নয়! সেটি যারা করেছিল তাদের পদাঙ্কই যদি অনুসরণ করতে হয় তাহলে এত রক্ত ঝরানোর, এত প্রাণনাশের, এত মানুষের অঙ্গহানির কি দরকার ছিল?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে প্রহার করে মৃতু্যর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ কোন সভ্যতা? ওপরে যে ঘটনাগুলোর উলেস্নখ করেছি সেগুলো ছাত্রলীগই করত। অনেকে ইচ্ছায়, অনেকে অনিচ্ছায়, অনেকে পার্টির জোর দেখানোর জন্য, অনেকে ক্ষমতার লোভে, অনেকে রাজনীতির বাতাসে বিষাক্ত হওয়ার কারণে, কেউবা এসব করত নিতান্ত বদভ্যাসের কারণে। তাদের সময় বিরোধী কোনো শিক্ষার্থীদের স্থান ছিল না ক্যাম্পাসে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সব সময় তটস্ত থাকতে হতো তাদের ভয়ে। কিন্তু তাই বলে আমরা কি সেই আগের কালচারই রক্ষা করে চলব? সেটিতো হতে পারে না।
ছাত্রলীগ করেছে, তারা আমাদের ওপর অত্যাচার করেছে, তাই আমরাও একই কাজ করব? তাহলে কোথায় মহানুভবতা? কোথায় পার্থক্য? মনের ভেতর প্রচুর ক্ষোভ জমে আছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এবং অন্য দলের সমর্থকদের সেটি আমরা বুঝি। কিন্তু সেটি তো ভালোবাসা দিয়ে জয় করা যায়। ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে যদি উল্টো মানবিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে জয় করা যায় সেটিই তাদের শাস্তি! তারা যা করতে পারেনি এখনকার শিক্ষার্থীরা তাই করছে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু না করাই তো তাদের শাস্তি। তাছাড়া বড় দলটির হাইকমান্ড তো বারবার সবাইকে অনুরোধ করেছে- যাতে আইন কেউ নিজের হাতে তুলে না নেয়। তারপরেও যারা নিচ্ছে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কারণ নিষ্ঠুরতা, নৈরাজ্য আর মগের মুলস্নুকের সংস্কৃতি হতে দেওয়া যাবে না। শাস্তি যদি কাউকে দিতেই হয় সেটি হতে পারে প্রতীকী কিন্তু প্রহার করে মেরে ফেলতে হবে? এই নৈরাজ্য যাতে আর কোথাও না হয় সেজন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীদের সর্বাত্মক দৃষ্টি রাখার জোর আহ্বান জানাচ্ছি। এ দেশ আমাদের সবার। সামান্য অঘটন থেকে বড় বড় দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেটি লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রক্টোরিয়াল বডিগুলো কি করছে? আগে তো ছাত্রলীগের ভয়ে কিছু করতে পারত না, বলতে পারত বা নিজেরাই ছাত্রলীগ ছিল বলে কিছু বলতো না। কিন্তু এখন তো সব পরিবর্তন করা হয়েছে। তারা কী করছেন?
এ ঘটনাগুলো বুয়েটে আবরার হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আবরার হত্যার ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল এবং বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। শিক্ষার্থীরা অবশ্যই রাজনীতি করবে কিন্তু রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়াবে না। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি হতে হবে পরিশীলিত ও আদর্শের, চর দখলের নয়।
মাছুম বিলস্নাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক