আলোক দূষণ :জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
বসবাসের জায়গায় উজ্জ্বল আলো দেয়া যাবে না, এতে মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়। হাসপাতাল এলাকায় অতিরিক্ত আলোতে রোগীদের অসুবিধা হয়। উজ্জ্বল আলো লাইব্রেরিতেও থাকতে পারবে না। ফলে লাইব্রেরির বাতিগুলো এমনভাবে দেওয়া হয়, যা শুধু বইয়ের পাতার ওপরই পড়ে। বর্তমানে এই আলোক-দূষণের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অমল বড়ুয়া
তমঃ অন্ধকার বিদিশার দোর খোলে অনির্বাচনীয় অবারিত আলোয় অবগাহনে জীবন হয় শুদ্ধ-ঋদ্ধ ও পরিশীলিত। জীবনকে আলোকিত করার পবিত্র প্রয়াসে ব্যাপৃত তাবৎ মানবজাতি। তাই আলোই জীবন আর অন্ধকার হলো অশুভ, অসুরতা, ভৌতিক, অজ্ঞতা ও মূঢ়তা। সৃষ্টি-গড়ায়, ধর্মে-কর্মে, শিল্প-সাহিত্যে তাই আলোরই জয়জয়কার; কবিকণ্ঠে ধরা দেয়- 'আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন ভরা; আলো নয়ন-ধোয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা।' কিন্তু আলোর আধিক্য আবার ঝুঁকির রক্তচক্ষুও দেখায়; যাকে বলা হয় লাইট পলিউশন বা আলোক-দূষণ। আর এই আলোক-দূষণ হলো অবাঞ্ছিত, অনুপযুক্ত বা অতিরিক্ত কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি। অর্থাৎ আলোক-দূষণ বলতে দিনে বা রাতে যে কোনো সময়ে পরিবেশে অত্যধিক মাত্রার দৃশ্যমান আলোর উপস্থিতিকে বোঝায়। মূলত আলোক-দূষণ হলো রাতের বেলায় মানবসৃষ্ট অতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত আলো। বর্তমানে দেশের সব স্তরেই আলোক-দূষণ একটি নতুন সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই দূষণের জন্য মূলত কৃত্রিম আলো দায়ী। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় এবং বেশি সময় ধরে জ্বলে থাকা আলো অস্বস্তি আর বিরক্তির পাশাপাশি অন্য সমস্যাও তৈরি করে। কৃত্রিম উৎস থেকে এই আলো আসে- যেমন বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, সড়কবাতি, বিলবোর্ড, গাড়ির হেডলাইট ও আলোকসজ্জায় ব্যবহৃত আলো। আলোক-দূষণ দুই প্রকার- প্রথমটি হলো পয়েন্ট সোর্স- যা সরাসরি কোনো একক উৎস থেকে আসে; অন্যটি স্কাই-গেস্না- যা দিগন্তের আকাশকে আলোকিত অবস্থায় দেখা যায়। এটি পয়েন্ট সোর্স লাইটিংয়ের সম্মিলিতভাবে জমে থাকার প্রভাব যা বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এটাকেই স্কাই-গেস্না বলে। বিশ্বজুড়ে প্রায় এক চতুর্থাংশ অঞ্চলের আকাশ এখন আলোক-দূষণের আওতায়। শহরে প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জন কখনো আদিম অন্ধকার আকাশের বিস্ময় অনুভব করেননি। বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন শিশু-কিশোর তারা যেই ছায়াপথে বসবাস করে তা দেখার সৌভাগ্য কখনোই লাভ করে না।
২০১৬ সালের 'ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অব আর্টিফিশিয়াল নাইট'-এর স্কাই ব্রাইটনেসের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ এ রকম আলোক-দূষিত আকাশের নিচে বাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ৯৯ শতাংশ মানুষ প্রাকৃতিক রাত উপভোগ করতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলো যেখানে প্রয়োজন, শুধু সেখানেই ব্যবহার করা উচিত, অপ্রয়োজনীয় আলো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 'নেক্সাস বিটুইন লাইট পলিউশন অ্যান্ড এয়ার টেম্পারেচার : দ্য স্টাডি অব বাংলাদেশ' শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আলোক-দূষণ বাড়ছে বাংলাদেশে। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে সমগ্র বাংলাদেশের মাত্র সাত দশমিক এক শতাংশ এলাকায় আলোক-দূষণ হতো। কিন্তু এক দশক পরে আলো-দূষণ বেড়ে হয়েছে ২৫ দশমিক চার শতাংশ। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন কাউন্সিল অন সায়েন্স অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-২০১২ এর প্রতিবেদন মতে, রাতে কৃত্রিম আলো মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এতে বেশ কিছু ঝুঁকিও রয়েছে- যার মধ্যে ঘুমের ব্যাঘাত, বিষণ্নতা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, হৃদরোগ ও ক্যান্সার উলেস্নখযোগ্য। ২০২৩ সালে আমেরিকান এজিং অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত আট চিকিৎসক এবং গবেষকের গবেষণাপত্র অনুসারে- আলোক-দূষণের সঙ্গে আলঝেইমার রোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আলোক-দূষণ একটি নতুন আলঝেইমারের ঝুঁকির কারণ; সন্ধ্যায় বাইরের আলোর প্রকটতা ৬৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে আলঝেইমারের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, 'মানুষের দেহে একটা জৈব ঘড়ি আছে- যা সূর্য ওঠা এবং ডোবার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এই অনাহূত আলোর জন্য ঘড়ির কাজে ব্যাঘাত ঘটে। আর মস্তিষ্ক যখন দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারে না, তখন নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি বিভিন্ন মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়। যেমন- অতিরিক্ত আলোতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, প্রেশার বেড়ে যায়, ডায়াবেটিসসহ নানা সমস্যা হয়।' আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন কাউন্সিল অন সায়েন্স অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-২০১২ এর গবেষণায় মানুষের স্তন ও প্রস্টেট ক্যানসারের জন্য আলোক-দূষণকেও দায়ী করা হয়েছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণির মতো মানুষ একটি সার্কেডিয়ান রিদম নামে পরিচিত প্রাকৃতিক শারীরিক চক্রের ওপর নিভর্রশীল। আমাদের জৈবিক ঘড়ি দিন এবং রাতের ঘুম চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাতের কৃত্রিম আলো সেই চক্রটিকে ব্যাহত করতে পারে। এর ফলে, প্রয়োজনীয় মেলাটোনিন নামক হরমোন (মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থি নিঃসৃত) নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হয়। মেলাটোনিন মূলত মানুষের ঘুমচক্র (সার্কাডিয়ান রিদম) নিয়ন্ত্রণ করে। আলোর উপস্থিতিতে মেলাটোনিন নিঃসরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই হরমোন কোষে সংঘটিত অস্বাভাবিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয় ও মানুষের বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণ করে। মেলাটোনিনের ক্যানসাররোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং সেই কারণে এই হরমোন নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হলে তা স্তন ও প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করে।
আলোক-দূষণ ক্ষতিকারক ঈঙ২ নিঃসরণও বাড়িয়ে দেয়। আর বিশ্বব্যাপী ৩১৭ মিলিয়ন রাস্তার আলো ২০২৭ সালে ৩৬৩ মিলিয়নে উন্নীত হবে। সড়কবাতির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে উৎপন্ন বিদু্যৎ ব্যবহার করা হয়। ২০১৭ সালে কার্বন নির্গমন ৩২ দশমিক ৫ গিগাটন ছিল এবং বিশ্বব্যাপী শক্তির চাহিদার কারণে আগামী বছরগুলোতে তার পরিমাণ আরও বাড়তে থাকবে। কার্বন নির্গমন বৃদ্ধির অর্থ পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে- যা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস'র প্রতিবেদন মতে, বৈদু্যতিক আলোর যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষ, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রকে অনেকভাবে ক্ষতি করছে। এ ছাড়া আলোর অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার অর্থনীতি ও জীবাশ্ম জ্বালানির অপচয় বলে অনেকে মনে করেন। মানুষ ছাড়াও, কৃত্রিম আলো অন্যান্য জীব এবং বাস্তুতন্ত্রকেও প্রভাবিত করে। এটি শারীরবৃত্তীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে, প্রতিযোগিতামূলক মিথস্ক্রিয়া পরিবর্তন করতে পারে, নেভিগেশন বিপর্যস্ত করতে পারে এবং শিকারী-শিকার সম্পর্ক পরিবর্তন করতে পারে। আলোক-দূষণ হালকা দূষণ ছাড়াও শেওলা জাতীয় উদ্ভিদের ক্ষতি করে, যা নদনদী ও হ্রদের গাছপালাকে মেরে ফেলতে পারে এবং পানির গুণগতমানকে খারাপ করতে পারে। মোটকথা, আলোক-দূষণ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ব্যাহত করার ক্ষমতা রাখে এবং প্রজাতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। যে প্রাণীরা সারা রাত সক্রিয় থাকে এবং অন্ধকারের ওপর নির্ভর করে তারা অত্যধিক কৃত্রিম আলোকসজ্জার প্রতিক্রিয়ায় তাদের আচরণ বা জীবন্ত পরিবেশ পরিবর্তন করতে পারে। পাখি, পোকামাকড় এবং অন্যান্য নিশাচর প্রজাতির অভিবাসন পদ্ধতি, প্রজনন আচরণ এবং খাদ্যাভ্যাস বিরূপ প্রভাবের শিকার হতে পারে। 'পিপল ফর এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার' নামক প্রাণী কল্যাণ সংগঠনের মতে, 'আলোর কারণে পাখিদের জন্য রাত নামে না।' আলো পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কারণ এটি প্রাকৃতিক আলোকচক্রকে বিঘ্নিত করে- যার প্রভাব বিভিন্ন প্রজাতির ওপরে পড়ে।
বসবাসের জায়গায় উজ্জ্বল আলো দেয়া যাবে না, এতে মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়। হাসপাতাল এলাকায় অতিরিক্ত আলোতে রোগীদের অসুবিধা হয়। উজ্জ্বল আলো লাইব্রেরিতেও থাকতে পারবে না। ফলে লাইব্রেরির বাতিগুলো এমনভাবে দেওয়া হয়, যা শুধু বইয়ের পাতার ওপরই পড়ে। বর্তমানে এই আলোক-দূষণের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
\হতবে কত মাত্রার আলো দূষণের পর্যায়ে পড়বে না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মানদন্ড নেই। কারণ, তা নির্ভর করে স্থানের ধরন, আয়তন, গুরুত্ব ও পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। এক্ষেত্রে কোনো স্থানের আয়তন যদি ১০০ বর্গফুট হয়, সেক্ষেত্রে সেই স্থানের অভ্যন্তরীণ আলোর মাত্রা আনুমানিক ৭৪ থেকে ২১০ ওয়াটের মাঝে থাকতে হবে। আবার ভবনের বাইরের আলোর ক্ষেত্রে এটি হওয়া উচিত ৪৯ থেকে ৯১ ওয়াটের মধ্যে। বাংলাদেশের জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮-তে আলোক-দূষণ সম্বন্ধে স্পষ্ট করে বলা আছে যে, 'আলোক-দূষণ রোধ করতে হবে।' বিশ্বব্যাপী আলোক-দূষণ কমাতে বিশেষজ্ঞদের মতে পাঁচটি মূল কৌশল ব্যবহার যায়- তা হলো: পূর্ববর্তী অন্ধকার অঞ্চলে আলোর ভূমিকা এড়ানো উচিত; আলো সর্বনিম্ন ব্যবহারযোগ্য তীব্রতায় ব্যবহার করা; আলো কেবল যেখানে প্রয়োজন সেখানেই শুধু ব্যবহার করা উচিত; আলো উষ্ণ হওয়া উচিত, যার অর্থ তীব্র সাদা বর্ণালির পরিবর্তে কমলা রঙের আলো বেশি ব্যবহার করা উচিত। আলো দূষণের ফলে যেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য যথেষ্ট সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। আলোক-দূষণ রোধের মাধ্যমে জীবন হোক আলোয় আলোকময়।
অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট