সীমান্তবর্তী লোকালয় বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। কেবলই চেয়ে চেয়ে দেখছি আমরা। করার যেন কিছুই নেই। আমরা কেবলই ভারতের বলির পাঁঠা। প্রতিবাদ হচ্ছে না- তা নয়। মিনমিনে প্রতিবাদ। জোরালো কণ্ঠে প্রতিবাদ করলে যেন রক্ষা নেই। টুটি চেঁপে ধরা হবে। নয়ত গদি নিয়ে কাড়াকাড়ি। এ ভয় যেন সব সরকারকেই পেয়ে বসে। তাই চুপ একদম চুপ। সেই স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সীমান্তে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিএনপি এ নিয়ে হম্বিতম্বি করে। একই অবস্থা এখনো। লাশের পর লাশ পড়লেও ২/৪ কথা ছাড়া তেমন কিইবা হচ্ছে। বরাবরের মতো বিএসএফ দুঃখ প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করছে। কিন্তু ভারতে সুনাগরিকদের মহামূল্যবান প্রাণ সীমান্তে বাঙালির হাতে গেছেতো আর রক্ষে নেই। এর আগে ভারতীয় নাগরিককে হত্যার দায়ে বাংলাদেশের বিডিআর সদস্যকে কমান্ডুস্টাইলে তুলে নিয়ে গেছে বিএসএফ। ওরা পারে, তাই সব সময় এটা করে। রাজা প্রজার ব্যাপার আর কী। গরীর আর দুর্বল রাষ্ট্রের নাগরিক হলে যা হয়, তাই হয় আমাদের। ব্যাপারটা এমন আমরা মরলে গরু ছাগল আর ভারতীয়রা মরলে সুনাগরিক (মানুষ)। বিষয়টি বরাবরই তা লক্ষ্য করে আসছি আমরা। সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশি নাগরিকে হত্যা করা হলে ক'দিন হৈচৈ আর আইনি মারপঁ্যাচ ছাড়া আর কিছুই হয় না। এ ব্যাপারে বহু দেনদরবার বৈঠক হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যন্ত কারো অঙ্গীকারই ঠিক থাকছে না। তাদের প্রতিশ্রম্নতির পুরোটাই প্রহসন!
আমরা হতবাক হয়ে দেখছি, পাথর ছুড়ে আহত করে এবং নদীতে ডুবিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে। অতিসম্প্রতি মেহেরপুর ও দিনাজপুরে গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করা হলেও কুড়িগ্রামে বোমা নিক্ষেপ করে একজনকে হত্যা করা হয়। জেলার ফুলবাড়িয়া সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের সংযোগ সেতুর কাছে দুই বাংলাদেশি নাগরিকের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে বিএসএফ। এতে একজন নিহত ও একজন গুরুতর আহত হন। এর আগে বোমা নিক্ষেপ করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার কোনো খবর আমরা পাইনি। সন্ত্রাসীদের মতো বোমা মেরে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা এই প্রথম। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ক্ষেত্রে বিএসএফ বারবার ওয়াদা ভঙ্গ এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করছে। ভারত বারবার বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপনের দাবি জানালেও এ দেশের নাগরিকদের সঙ্গে ভারতের আচরণ চরম শত্রম্নতামূলক। এভাবে বেপরোয়া হয়ে সীমান্তে প্রতিবেশী দেশের নাগরিক হত্যা কোনো সুসভ্য দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী করতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি এবং মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এ ধরনের হত্যাকান্ড মারাত্মক অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত। আইনি দৃষ্টিতে এ ধরনের ঘটনা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। আর এই অবিচারমূলক হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে বিএসএফ ঔদ্ধত্যপূর্ণ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তারা কোনো ধরনের ন্যায়নীতি, বিবেক ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে না। বিএসএফকে খুনি বাহিনী হিসেবে উলেস্নখ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
ক'দিন আগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশি যুবক হাবিবুর রহমান ওরফে হবুর নির্মম নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। যার ভিডিও চিত্র এ দেশবাসীকেই নয়, বিশ্ব বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। খোদ তাদের দেশীয় বহুলপ্রচারিত পত্রিকা দ্য হিন্দু 'বাংলাদেশের কাছে নয়াদিলিস্নর নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল' এমন শিরোনামে সম্পাদকীয় ছাপে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভিডিওচিত্রটি বাংলাদেশের মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এমনিতে বর্তমান বাংলাদেশের সরকারকে ভারতপন্থি বলা হচ্ছে। তার ওপর সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির বক্তৃতা বিষয়টিকে আরও উসকে দিতে পারে বা 'ভারতপন্থি' কথাটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে নয়াদিলিস্নর এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে দেশটিতে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, গত মাসে সীমান্তে বিএসএফের হাতে পৃথক দুটি ঘটনায় তিন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পর দেশটিতে ভারতবিরোধী মনোভাব চরম আকার ধারণ করে। তাই দিলিস্নর এখনই উচিত তার প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত যে কোনো ঘটনা থেকে সুরক্ষিত থাকতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আরও বলা হয়, সীমান্তে অবৈধ কার্যকলাপ ঠেকাতে গুলি ব্যবহার না করার বিষয়ে ২০১১ সালের মার্চে দু'দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে। এ সমঝোতার পর প্রাণহানির ঘটনা কমে এসেছে। তবে সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া এ ভিডিওচিত্র এটাই প্রমাণ করে যে, বিএসএফ ইচ্ছামতো সহিংস আচরণ করছে।
দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, বিএসএফের এসব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকার প্রতিবাদ করছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। ভারতবান্ধব এই সরকার ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণে তাদের সব চাহিদা পূরণ করলেও বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এ বছরের শুরুতে কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে যাওয়া কিশোরী ফালানীকে ঘাতক বিএসএফ কাছে থেকে গুলি করে হত্যা করেছিল। লজ্জার বিষয়, সেই হত্যাকান্ডেরও জোরালো কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। তবুও আমরা আশা করি, সীমান্তে বোমা নিক্ষেপ, গুলি ও পাথর ছুড়ে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হবে। এইতো সেদিন গাংনী সীমান্তে জনৈক নাহারুলকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ লাশ নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানতে পারেনি বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসন। এদিকে দুই বাংলাদেশি যুবককে ভারতের গিদালদাহ ক্যাম্পের বিএসএফ গুলি করে আহত করলে একজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, অন্যজনকে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। ওই দুই যুবকসহ কয়েকজন গরু ব্যবসায়ী গরু আনতে গেলে বিএসএফের রাবার বুলেটে আহত হন। সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বন্ধ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ দাবি জানিয়ে আসছে। এ নিয়ে কতবার যে পতাকা বৈঠক হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এরপর বিডিআর (বিজিবি)-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে ঢাকা-দিলিস্নতে। প্রতিবারই বিএসএফ মহাপরিচালক স্পষ্ট ভাষায় প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন, সীমান্তে আর হত্যাকান্ড হবে না। কিন্তু এসব প্রতিশ্রম্নতি এতটাই প্রহসনমূলক ছিল যে, প্রতিবারই তার ঘোষণার ক'দিন পরই আবার বিএসএফের গুলি চলেছে এবং নিহত-আহত হয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিক। আসলে বিএসএফের এসব প্রতিশ্রম্নতি সবই গরল ভেল!
আত্মরক্ষার নামে কৃষক, দিনমজুর, গরু ব্যবসায়ীসহ শত শত লোককে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। বিএসএফের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে ভারতেরই অনেক মানবাধিকার সংগঠন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মাত্র একটি জেলার বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ভারতের সাড়াজাগানো সাপ্তাহিক তেহেলকা সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সময়োপযোগী বিবেচিত হওয়ায় তুষা মিত্তালের ওই প্রতিবেদনটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রকাশ করা হলো। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ঠিক কত লোক হত্যার শিকার হন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। কলকাতাভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন মাসুমের মতে, ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের মাত্র দুটি জেলা মুর্শিদাবাদ ও উত্তর চব্বিশপরগনা সীমান্তে ১৬৫ জন হত্যার শিকার হন। এই দুটি জেলা গোটা পশ্চিমবঙ্গের মাত্র ৮ ভাগ এলাকা নিয়ে গঠিত। শহর থেকে অনেক দূরের এই ঝাপসা ভূখন্ডে সীমান্তে হামেশাই মানব পাচার, অবৈধ অভিবাসন, মাদক ব্যবসা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। অসাবধানি গুলি এই সীমান্তকে যেমন উপদ্রম্নত করে, তেমনি হয় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি।
এদিকে, বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর হিসাবমতে, গত ১০ বছরে ভারতীয় বিএসএফ কমপক্ষে এক হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৪৭ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যার কথা স্বীকার করেছে বিএসএফ। বিএসএফের হাতে এ সময় ১৬৪ জন ভারতীয় নাগরিকও নিহত হয়। বিএসএফের মহাপরিচালক রমণ শ্রীবান্তব ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যার কথা স্বীকার করেন। ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিএসএফ কোনো নিরাপরাধ নাগরিককে হত্যা করে দায়মুক্তি পেতে পারে না। বিএসএফ শুধু আত্মরক্ষার জন্যই গুলি করতে পারে। কিন্তু এই সুযোগের চরম অপব্যবহার করে আসছে বিএসএফ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৩ বছরের আসিফ ইকবাল, ১৫ বছর বয়স্ক শাহীন শেখকে হত্যা করে বিএসএফ। ১৫ বছর বয়স্ক সুমন্ত মন্ডলকে মাঠে সরিষা তোলার সময় হত্যা করে বিএসএফ। আবদুস সালাম নামের এক দিনমজুরকে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। কলকাতাভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন মাসুমের প্রতিষ্ঠাতা কৃতী রায় বলেন, 'এসব অপরাধের জন্য কোনো বিএসএফ সদস্যকে গ্রেপ্তার কিংবা দায়ী করা হয়নি। সীমান্তরক্ষা আইন অনুযায়ী বেসামরিক আদালতে বিএসএফ সদস্যদের বিচার করা যায় না।' বিএসএফের নিজস্ব আদালতে এসবের 'বিচার' করা হয়; কিন্তু আদালতের রায় প্রকাশ করা হয় না।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের রাতে বিএসএফের গুলিতে আবার বাংলাদেশি নাগরিকের রক্তে রঞ্জিত হলো ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। এ নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে গাংনী (মেহেরপুর) সীমান্তে। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)-বিএসএফ পতাকা বৈঠকের একদিন পর গাংনী উপজেলার সহড়াবাড়িয়া সীমান্তে এক বাংলাদেশিকে গুলি করে মেরেছে বিএসএফ। হত্যার পর লাশ নিয়ে গেছে তারা। এদিকে ১৫ ডিসেম্বর রাতে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে দুই যুবক আহত হয়েছে বিএসএফের গুলিতে। আহতদের একজনকে অপহরণ করে বিএসএফ নিয়ে গেছে অজ্ঞাত স্থানে। সারাদেশ যখন বিজয় দিবস পালনের আনন্দে উদ্বেল তখন এ ধরনের বিষাদময় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশ সীমান্তে। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের বিজয়ে সহযোগিতা করে যে সৌহার্দের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, চার দশক পর বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় সেই স্মৃতিপটে যেন রক্ত লেপন করে দিল। গত চলিস্নশ বছরে সীমান্তে একর পর এক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বিএসএফ। কিছুতেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বন্ধ হচ্ছে না; বরং এই হত্যাকান্ডের রূপ বদলে গেছে। বিএসএফের মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফরে এসে সম্প্রতি প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে না।
ভারত-বাংলাদেশ বিস্তীর্ণ সীমান্ত ঘিরে সব সময়ই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য হচ্ছে। আমরা চাই, আর না চাই, এটা চলছে। এই সীমান্ত অর্থনীতির উপকারভোগীদের মধ্যে রয়েছে উভয় দেশের সীমান্ত সংলগ্ন লাখ লাখ গরিব মানুষ। সেখানেও সীমান্ত রক্ষা বা নিরাপত্তার নামে এসব অশিক্ষিত গরিব মানুষ যারা সীমান্ত বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত নন, তাদের পারাপারে দেখামাত্রই গুলি করে পাখির মতো মারতে হবে এটা কোনো মানবিক ঘটনা হতে পারে না। বৈঠকে বিএসএফের পক্ষ থেকে বারবারই প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয় তারা এমনভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষা করবে, যাতে মানুষ না মারা যায় কিন্তু এই প্রতিশ্রম্নতি বায়বীয়। অনেক সময় এমনও হয়েছে, একদিকে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠক চলছে; অন্যদিকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করছে বাংলাদেশিকে। ঘটনাগুলো দেখে মনে হয় বিএসএফ কালবিলম্ব না করে সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলতেই উৎসাহী। এ যেন এক আক্রোশ কিন্তু কেন এই আক্রোশ? সীমান্তে পৌনঃপুনিক বাংলাদেশি হত্যার দায়ভারটা শেষবিচারে কিন্তু গিয়ে পড়ে ভারতের রাজনৈতিক সরকারের ওপরই; কারণ নির্দেশটা সেখান থেকেই আসছে। দেখামাত্রই গুলি এমন নির্দেশ অবশ্যই আছে, তাই বিএসএফ ন্যূনতম অপেক্ষা না করে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষগুলোকে এভাবে হত্যা করছে। তাহলে এটা ধরে নেয়া কি খুব ভুল হবে, হাজার মৌখিক আশ্বাস থাকলেও ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রয়েছে বলেই সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা অব্যাহত রয়েছে। শুধু হত্যা ও আহত করাই নয়, বিএসএফ বরাবরই সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে নানা ধরনের দুষ্কর্মে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ভূখন্ডে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে চাষাবাদ, সীমান্ত পিলার ভাঙা, নদী থেকে জোর করে মাছ লুট, বাংলাদেশ এলাকায় নদীতে জেগে ওঠা চর জবরদখল ইত্যাকার অনৈতিক কাজে তারা লিপ্ত ছিল, আছে। বস্তুত, ভারত আগাগোড়াই বাংলাদেশকে দেয়া কোনো অঙ্গীকার রক্ষা করছে না। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, তিস্তা চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে সীমান্ত হত্যাকান্ড, বাংলাদেশের ভূখন্ডে বিনা উসকানিতে অনুপ্রবেশ সব ক্ষেত্রেই মুখে এক, মনে অন্য। এসব ব্যাপারে বর্তমান সরকারের ভূমিকাও স্বচ্ছ নয়। ভারত যা খুশি করে পার পেয়ে যাচ্ছে। তারা করিডোর আদায় করেছে, অথচ আইনগত দিক উপেক্ষা করে টিপাইমুখ বাঁধের জন্য প্রাথমিক সব কাজই সম্পন্ন করে ফেলেছে। বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীর চাপের মুখে যতটা প্রতিবাদ করছে তা এতই মৃদু যে, ভারত তোয়াক্কাই করছে না। সরকারের এই 'দেখি না কী হয়' নীতি ক্রমেই দেশবাসীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে তুলছে।
এটা অস্বীকার কারার উপায় নেই যে, সীমান্তে চোরাকারবারির উপস্থিতি নেই। উভয় সীমান্তের হয়ত কিছু কিছু নাগরিক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু শুধু গরুই চোরাচালান হয় না। মাদক ও অস্ত্রও চোরাচালান হয়। দীর্ঘদিন থেকেই সীমান্তবর্তী ভারতীয় গ্রামগুলো হয়ে উঠেছে ফেনসিডিল ও অস্ত্র তৈরির অভয়াশ্রম। প্রতিদিন ওপার থেকে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল এপারে পাচার হচ্ছে, পাচার হচ্ছে অস্ত্রও। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এসব বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফেনসিডিলের সর্বগ্রাসী ছোবলে দেশের লাখ লাখ যুবক আজ নেশার জগতে আচ্ছন্ন। অবৈধভাবে আসা অস্ত্র রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য দিন দিন হুমকি হয়ে উঠছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের কাছ থেকে আমরা যথার্থ সহযোগিতা কামনা করি। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় দিলিস্ন আমাদের পাশে থাকবে শুনে আমরা আশ্বস্ত হই কিন্তু ভারত কি সে উদারতা দেখাতে সক্ষম? বলতে দ্বিধা নেই ভারত সরকার এসব সীমান্ত হত্যা, নদীর পানির হিস্যা ইত্যাদি জিইয়ে রেখে নোংরা ও বিবেকহীন পলিটিক্স চালিয়ে যেতে চাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারত একটি উদীয়মান শক্তি। বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে এত শক্তিশালী প্রতিবেশীকে মোকাবিলা করা কঠিন। তাই সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিষয়টি উত্থাপন করা। এজন্য আমাদের নীতিনির্ধারক মহলের আরও কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। সত্যিকারভাবে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না পাল্টালে সীমান্তে এভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা বন্ধ হবে না। এখন প্রশ্ন হলো ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই প্রশ্নে আন্তরিক কিনা? ভারত নিজেও অনুধাবন করবে, এ জাতীয় চলতে থাকা হত্যা দুই দেশের সুসম্পর্কের ওপর গভীর অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণই তৈরি করবে- যা উভয়ের কাছেই কাম্য নয়। কিন্তু এ জাতীয় অনভিপ্রেত ঘটনার একটার পর একটা পুনরাবৃত্তি চলতে থাকলে বাংলাদেশই বা আর কতকাল একতরফা বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে থাকবে? গোটা বিষয়টি উপলব্ধির জন্য ভারতের রাজনৈতিক শুভবুদ্ধির প্রত্যাশাই আমরা করি। তাই আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছে হয়ত অনুরোধ করতে পারি, এভাবে নিরীহ মানুষকে খুন করা বন্ধ করুন।
আমরা আর সীমান্তে কোনো মানুষকে খুন দেখতে চাই না। আমরা চাই না, ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র থেকে সরে যাক।
মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ