পাঠক মত

সরকার হবে সেবক শাসক নয়

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মাসুদ পারভেজ
সংবিধান একটা দেশের গঠনতন্ত্র কিংবা একে দেশ পরিচালনার নিয়মনীতি বলা যেতে পারে। সংবিধান অবশ্যই একটা দেশের স্বর্বজনীন অভিপ্রায় এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হতে হবে।? অন্য কোনো দেশের সংবিধানের নীতি অনুসরণ করে সংবিধান রচনা মোটেও বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়। একটি দেশের গঠনতন্ত্র অবশ্যই সেই দেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপরে গবেষণা করে এবং তাদের যোগ্যতা ও সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে রচনা করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে যে অনুচ্ছেদ রয়েছে তা সুস্পষ্ট নয়। সংবিধানের ৫৬ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে সর্বাধিক আস্থাভাজন, তাকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন। এই সামান্য যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান নির্বাচন করা যথেষ্ট নয়। সরকারের উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকা নয়। একজন প্রধানমন্ত্রী মূলত প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্মকর্তা তিনি অবশ্যই জনগণের প্রভু নয়। অতএব, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্বের বিষয় হলো বিরোধী দলের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হবে এবং এ বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান থাকা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের ধারণা অনুযায়ী সরকারকে জনগণ পরোক্ষভাবে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারণ করে। কিন্তু গণতন্ত্রের এই ধারণা ব্যর্থ হয় যখন শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন কিংবা নির্ধারণ করা হয়। আসুন একটা সহজ হিসেবে আসা যাক- ধরুন 'ক' দল ৫৫ পার্সেন্ট ভোট পেল এবং 'খ' দল পেল ৪৫ পার্সেন্ট ভোট। তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো 'ক' দল। কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ 'খ' দলের মানুষ কোথায় যাবে? তাদের প্রতিনিধি কে হবে? ধরলাম জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে 'ক' দল পেল ২৫০টা আসন 'খ' দল পেল ৫০টা আসন। তাহলে জাতীয় সংসদে 'খ' দলের মতামতের জায়গাটা কোথায়? সংবিধানের বিল পাসের স্থানগুলোয়ও তো তাদের জায়গা হবে না, দুষ্পরিবর্তনীয় অনুচ্ছেদ না হয় বাদ রাখলাম। কারণ সংবিধানের দুষ্পরিবর্তনীয় অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদের মোট সদস্যদের তিনভাগের দুইভাগ ভোট লাগবে। যা হিসাব করলে দাঁড়ায় ৩০০ আসনের মধ্যে ২০০ আসন যার বেশিরভাগ ইতোমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পেয়ে বসে আছে। আর সাধারণ আইন পাসের ক্ষেত্রে সিম্পল মেজরিটি বা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার হয়। যার কোনো কিছুতেই বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের ভূমিকা পালনের এখতিয়ার নেই। এ সমস্যাগুলো নিয়ে কি কখনো ভেবে দেখেছেন? এটা কি সরষের মধ্যে ভূত নয়? গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটি সৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়? আমি সংখ্যালঘিষ্ঠ হলে কেন রাষ্ট্রের কাছে আমার কোনো রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না? সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা সমাধানের কয়েকটি পথ রয়েছে। প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের প্রধান যে হোক না কেন, সরকারপ্রধান হওয়ার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব থাকবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকারি দল আর বিরোধী দলের মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব। রাজনীতিতে এই ধারণার দুটো কারণ লক্ষ করা যায় একটা রাজনীতি সম্পর্কে নিরক্ষরতা অন্যটি ধার করা রাজনৈতিক মতাদর্শ। রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখতে দেখতে স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছর পার করে ফেলেছি। বিশ্বের কোনো দেশে বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারি দলের রাজনৈতিক সম্পর্ক কেমন হয়, সে বিষয়টি দেখে দেশের সাধারণ নাগরিকের কোনো উন্নয়ন হয় না। উন্নয়ন তখনই হবে যখন রাষ্ট্রপরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো উভয় দলের সদস্যদের সম্পৃক্ততা এবং বিরোধীদলের গঠনমূলক সমালোচনার মনোভাব থাকে। কোনো ব্যক্তি দুবারের বেশি সরকারপ্রধান হয়ে থাকতে পারবে না, যেটা ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। সংবিধানে অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে উলেস্নখ করতে হবে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের পাঁচজন যোগ্য ব্যক্তি সরকারপ্রধান হওয়ার জন্য প্রার্থী হবেন, এর কম বা বেশি নয়। এর মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন তিনি হবেন সরকারপ্রধান। এই ভোট অবশ্যই প্রকাশ্যে হতে হবে এবং জনগণ অবগত হতে পারবেন কে কোন প্রার্থীকে ভোট প্রদান করেছেন। এখানে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের আলাদা করে ভোট প্রদানে ব্যবস্থা থাকতে হবে। সরকার গঠনের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিরোধী দলের মোট সংসদ সদস্যদের অর্ধেকের বেশি ভোট প্রদান করবে তাবেই সরকার গঠন করা যাবে নতুবা সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলের সংলাপের ব্যবস্থা করবেন এবং সংলাপের নেতৃত্বে থাকবেন রাষ্ট্রপতি। বিল পাসের ক্ষেত্রেও বিরোধী দলের অর্ধেক ভোট আদায় করা বাধ্যতামূলক হতে হবে। সরকারের মন্ত্রী সভাগুলোয় অবশ্যই বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি থাকতেই হবে, হোক সেটা উপমন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী। রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে হবে, যেটা একেবারে করা হয় না। সংবিধানে আরও একটা অপ্রয়োজনীয় অনুচ্ছেদ হলো ৭০(খ) যেখানে নিজের দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়। এই অনুচ্ছেদের একটি অযৌক্তিক ব্যাখ্যা হলো দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই বিধান সংবিধানে রাখা হয়েছে কিন্তু প্রশ্ন হলো দলীয় শৃঙ্খলা দিয়ে জনগণের কোন উপকারটা হয়? কোনো দলীয় সরকারপ্রধান যদি অনৈতিক এবং মানবতাবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে দলীয় সংসদ সদস্য বিরোধিতা করতে পারবে না, এটা মোটেও যৌক্তিক হতে পারে না। এখানে ব্যক্তির নৈতিকতাকে আঘাত করা হয়। মাসুদ পারভেজ শিক্ষার্থী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া