দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নতুন বিতর্ক

শেখ হাসিনার পদত্যাগকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে।

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও এর পেছনের ঘটনাপ্রবাহকে ঘিরে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নতুন মাত্রার বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশের ইতিহাসে গণ-আন্দোলন এবং ক্ষমতা পরিবর্তনের ঘটনাগুলো সব সময়ই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। শেখ হাসিনার সাম্প্র্রতিক পদত্যাগকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। হাসিনার দাবি অনুযায়ী, এই পদত্যাগের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কিন্তু এই দাবি কতটা সত্য ও যৌক্তিক, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মতো বৃহৎ শক্তিগুলো ভিন্নমত পোষণ করেছে। ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। বাংলাদেশে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে গণবিপস্নবের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে এবং এবারের ঘটনাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে হাসিনা ও তার সমর্থকদের দাবি অনুযায়ী, এই আন্দোলন কোনো সাধারণ অভু্যত্থান নয়, বরং এর পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনার দাবি, যুক্তরাষ্ট্র তার সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র করেছিল, যা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সাল থেকে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য, দ্য সানডে গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকেই হাসিনাকে উৎখাতের পরিকল্পনা করছিল। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বিরোধিতা করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, হাসিনার পদত্যাগ ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের ফল এবং এতে তাদের কোনো হাত নেই। দ্য সানডে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রকল্পে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই), ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (এনইডি) এবং ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) সরাসরি জড়িত ছিল। এসব সংস্থার মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রচার এবং সরকারের পরিবর্তনে কাজ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। আইআরআই ২০১৯ সালের মার্চ মাসে 'প্রমোটিং অ্যাকাউন্টেবিলিটি, ইনক্লুসিটি এবং রেজিলিয়েন্সি সাপোর্ট প্রোগ্রাম' নামে একটি প্রকল্প শুরু করে- যা ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের রাজনীতিতে নতুন শক্তি যোগ করা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা। আইআরআই বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে যুবক ও নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছে। প্রতিবেদনে আরও উলেস্নখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভারতের প্রভাব প্রতিরোধে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব স্পষ্ট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক শক্তিশালী হলেও, অন্য শক্তিগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, এ সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে চেয়েছিল। ভারতের অবস্থান মূলত শেখ হাসিনার পক্ষে থাকলেও, এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। দ্য সানডে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র হাসিনাকে ক্ষমতাচু্যত করার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, যাতে ভারতের হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা হয়। এর ফলে, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কেও নতুন প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রচারের জন্য কাজ করে থাকে, বিশেষত আইআরআই এবং এনইডি এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। কিন্তু অনেক সময়ই এই সংস্থাগুলো বিদেশি সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। মঙ্গোলিয়া, হাইতি এবং উগান্ডার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রচারের কৌশল সমালোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমালোচনা উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির একটি প্রধান দিক হলো গণতন্ত্র প্রচার। তবে এটি প্রায়ই স্বার্থান্বেষী কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হয়। শেখ হাসিনার পতন নিয়ে ওঠা বিতর্ক নতুন করে এই প্রশ্ন তুলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কীভাবে এবং কোন উদ্দেশ্যে এই ধরনের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশে আইআরআই-এর কার্যক্রমের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই প্রকল্পের অধীনে সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে স্থানীয় ফোরামে নাগরিককেন্দ্রিক আলোচনা সংঘটিত হয়। আইআরআই বিভিন্ন শিল্পী ও সংগঠনের সঙ্গে কাজ করে- যা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশে কিছু মাত্রা যোগ করেছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে অহিংস রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার করা হয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারীদের ক্ষমতায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। তবে এসব উদ্যোগ সত্ত্বেও এটি কতটা প্রভাব ফেলেছে বা ক্ষমতার ভারসাম্য বদলাতে পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমন্বয়ে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। এই পদত্যাগ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক বাংলাদেশকে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে- তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রচারের প্রকল্পগুলো কতটা কার্যকর ছিল এবং এটি বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা এনে দিতে পেরেছে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এটি নিশ্চিত যে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং এর পেছনের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনার পদত্যাগকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে। \হযুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনার পতনের পেছনে শুধু অভ্যন্তরীণ গণ-আন্দোলন নাকি বিদেশি হস্তক্ষেপ ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক চলবে। তবে এ ঘটনাটি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আন্তর্জাতিক রাজনীতির শক্তি ও স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক, লেখক ৎধংযবষ.ৎঢ়সপ@মসধরষ.পড়স