নদী শব্দটির সঙ্গে আমরা অতি পরিচিত। বাংলার বিচিত্র ভূ-প্রকৃতিতে নদীর দান অপরিসীম। প্রধানত নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষের বসতি। শহর, নগর, বন্দর পৃথিবীর সব সভ্যতার সূচনা। মানব শরীরে সচল রক্তশিরার মতো নদীও এ দেশের প্রাণ। মানুষের যেমন প্রাণ আছে, নদীরও তেমন প্রাণ আছে। নদী জীবন্ত, নদী জীবন্ত সত্তা। নদীর কাছে মানব সভ্যতার ঋণ অপরিসীম। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই জীবন্ত প্রাণ নিয়ে রয়েছে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রামে নদীর উপস্থিতি নিরবচ্ছিন্ন। আছে নদীকেন্দ্রিক পরিচয়ের প্রাধান্য, রাজনীতির স্স্নোগানও পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/তোমার আমার ঠিকানা। স্বাধীনতার যুদ্ধেও রয়েছে নদীর অবদান, নদী নিয়ে রয়েছে কত শত গান, কবিতা। এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না। আজ সেই নদী নিয়ে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গান আর আমাদের মাঝে নেই। নদীর অবদানও আমরা ভুলে গেছি। কি অকৃতজ্ঞ আমরা, যে নদী দিয়েছে আমাদের সভ্যতা, যে নদী দিয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- স্বাধীনতা, যে নদীর মাঝে রয়েছে আমাদের জীবিকা, অপার সম্ভাবনা। আজ সেই নদীই হারিয়ে গেছে, নদী কাঁদছে, নদীর কান্না কেউ শুনতে পায় না বা শুনতে চায়ও না।
বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলেই মাতৃক শব্দটি এসে যায়। বলা হয়ে থাকে, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। বিপন্ন 'প্রাণী'র নাম 'নদী'। বিশ্বে হয়তো একটি দেশ রয়েছে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যাকে বলা হয় নদীমাতৃক। নদীকে যদি মা বলি তাতেও মনে হয় ভুল হবে না। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করে আসছে। নদীকে ঘিরে দেশে কয়েকটি দিবস পালিত হচ্ছে। এর ফলে, নদী সুরক্ষায় কি কোনো সুফল মিলছে না। শুধু দিবসের দিনই সরকার থেকে গলাবাজি দেখা যায়, আর সারা বছরই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাদের নদী নিয়ে সভা, সেমিনার সিম্পোজিয়াম করতে দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে যারা দখল করছে তাদের কেউ দমাতে পারছে না। সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব সমুদ্র, প্রাকৃতিক জলাধার, বন (ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যতিরেকে), পাহাড়- সবকিছু মালিক হচ্ছে রাষ্ট্র, মানে জনগণ। সুতরাং, এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার দায়িত্বও তার। কিন্তু সেই জনগণেরই একটি অংশ যখন খাল, নদী, জলাশয়, পুকুর ভরাট করে, দখল করে, দূষণে বিপন্ন করে তখন সংবিধান প্রদত্ত এই মালিকানাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয় কিনা। তখন এটি প্রমাণিত হয় যে সংবিধান যাদের রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই জনগণ আসলে ক্ষমতা গ্রহণে রাজি নয় কিংবা তারা এই মালিকানা চায় না। চায় না বলেই সে তার মা'কে বিপন্ন করে, নদীকে ধ্বংস করে।
নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিন্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা হবে না, এমনকি টেকসই উন্নয়নও সম্ভব নয়। নদীগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নদী রক্ষায় আমাদের তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা বা কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত 'রামসার কনভেনশন-১৯৭১' এবং 'রিও কনভেনশন-১৯৯২' স্বাক্ষর করায় ভূমি ও জলজ পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। এ কনভেনশন দু'টির প্রথমটি জলজ পাখির আবাস সংরক্ষণসংক্রান্ত- যা নদী ও জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষার ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়টি ভূমি ও জলের সব প্রজাতির উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত- যা একই লক্ষ্যে অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টাঙ্গুয়ার হাওড় ও সুন্দরবন এলাকা 'রামসার সাইট' হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হাকালুকি হাওড় এবং সুন্দরবনকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে 'পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা' ঘোষণা করায় ওই দুই এলাকার নদী ও জলাভূমিগুলো সংরক্ষণের বেলায় সরকারি দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু এখনই আমাদের দেশের আরও অনেক জলাভূমিকে 'রামসার সাইট' হিসেবে এবং 'পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
সারাদেশেই আগ্রাসী থাবায় নদীগুলো বিপর্যস্ত। যে কোনো নদীর পাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক নদনদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখীন। অনেক নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদনদীর মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে হয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটারের মতো। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই এটা ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা নানা কথা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশেও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। এই নদীই একটি জীবন্ত সত্তা। ২০১৯ সালের ৩ ফেরুয়ারি হাইকোর্ট একটি রায়ে নদীকে 'জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি)' বলে আদেশ জারি করেছে। এর অর্থ মানুষের মতো নদীরও সুস্থ সুন্দর থাকার অধিকার রয়েছে। দখল দূষণ ভরাটের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে রয়েছে আইনি অধিকার। এর আগে বিশ্বব্যাপী এ ধারণার সূচনা হয়েছে কলম্বিয়া থেকে ২০১৭ সালে। সোনা আর কয়লার খনির কারণে নদী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশটির সাংবিধানিক আদালত 'রিয়ো এট্রাটো' নামক একটি নদীকে এ অধিকার দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে নদীটিকে রক্ষার জন্যই আদালত একে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, নিউজিল্যান্ডের একটি নদীকে খুবই পবিত্র মনে করে এবং সেটিকেও জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজ্য আদালত থেকে নর্মদা নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কারণ নদীটি খাওয়ার পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি বছরের ২৫ ও ২৬ মে ঢাকার ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে দু'দিনের জাতীয় নদী সম্মেলন হয়েছে। ওই সম্মেলনে বেলার নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান এবং এএলআরডির নির্বাহী সামছুল হুদার আমন্ত্রণে আমিও ছিলাম। সারাদেশ থেকে পরিবেশবিদ, জলবায়ু যোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন। বেলার দেওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের ২২৯টি নদী সংকটাপন্ন। এসব নদী এখনই দখল ও দূষণমুক্ত করা যাবে না। তবে সরকার ও সবাই মিলে চাইলে ৬৪টি জেলার একটি করে নদীকে দুই বছরের মধ্যে দখল ও দূষণমুক্ত করা সম্ভব। সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নদী সংকটাপন্ন রংপুর বিভাগে, ৪৩টি। তা ছাড়া সিলেটের ৪২টি, খুলনায় ৩৭টি, বরিশালে ৩০টি, ঢাকায় ২৮টি, রাজশাহীতে ১৯টি, চট্টগ্রামে ১৭টি ও ময়মনসিংহে ১৩টি নদী সংকটাপন্ন। আমিও ওই সেমিনারে নদী রক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশামালাও তুলে ধরেছিলাম। জাতীয় নদী সম্মেলন শেষে পরিবেশ ও জলাবায়ু বিশেষজ্ঞ শরীফ জামিল ভাইয়ের আমন্ত্রণে সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে 'উপকূলের কৃষি ও মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে করণীয়' শীর্ষক আলোচনা সভায়ও ছিলাম। সেখানে উপকূলের কৃষি ও মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে আলোচনার শীর্ষে ছিল নদী দখল, নদী দূষণ, পস্নাস্টিক বর্জ্যের কারণে শুধু যে নদী অস্তিত্বের মধ্যে পড়েছে তা কিন্তু নয়, মৎস্য ও কৃষিসম্পদও হুমকির মুখে। আমাদের সবার একই কথা নদীকে নদীর মতো চলতে দিতে হবে, দখলমুক্ত করতে হবে, দূষণমুক্ত করতে হবে। তাহলে কেন এত হত্যাযজ্ঞ? এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে।
নদী জীবন্ত এটি অস্বীকার বা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতিতে প্রাণের সৃষ্টি যে জলজ পরিবেশে তা অনেকেরই অজানা নয়। যেখানে পানি নেই, সেখানে প্রাণের সৃষ্টিও নেই। অজস্র অণুজীব, শ্যাওলা, শামুক-ঝিনুক, সাপ, ব্যাঙ, মাছসহ, আগাছা ছোট-বড় বৃক্ষ-লতাসহ সব প্রাণের সৃষ্টি, বিকাশ, বিবর্তন, বৃদ্ধি এবং বিস্তৃতি জলাধারের প্রতিবেশকে ঘিরে। বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, রাতচোরা, শিশুক, উদবিড়ালসহ হাজারও প্রাণের সমাহার। জেলেদের মাছ ধরা, জুগিদের শামুক ঝিনুক থেকে চুন তৈরি ঘিরে ঐতিহ্যবাহী পেশা, চাষিদের ফসল উৎপাদনসহ অসংখ্য জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষভাবে জীবন-জীবিকা এবং কৃষি-কৃষ্টি, সাহিত্য-সংস্কৃতি সবই এই পরিমন্ডলের দ্বারা প্রভাবিত ও প্রচলিত। আবার আবহাওয়া ও জলবায়ু বৃষ্টি বাদল খরা সবই, নদী-নালার পানিপ্রবাহ দ্বারাই হাজার হাজার বছর ধরে নিয়ন্ত্রিত। এক কথায় জলজ প্রতিবেশ তথা নদী হলো এ দেশের প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ ও আমাদের জীবন সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ। নদী নিয়ে এত আইন, পরিবেশ রক্ষার জন্য এত আইন, হাইকোর্টের আদেশ থাকা সত্ত্বেও নদী রক্ষা নিয়ে কারো কোনো ভাবনাই নেই। নদী নিয়ে এত দিবস পালন হয় বলতে পারেন নদীর কোনো পরিবর্তন হয়েছে? বলতে পারেন নদী দখল, দূষণ বা ভরাটের অপরাধে কাউকে আটক, গ্রেপ্তার বা শাস্তি দেওয়া হয়েছে? আমাদের দেশে নদী নিয়ে দিবস। এসব দিবস দেশজুড়ে বেশ ভালোভাবেই পালিত হচ্ছে। আর সুফল যদি ধরেন, তবে সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আগে নদী দখল-দূষণের বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে খুব বেশি গুরুত্ব পেত না। অনেকেই মনে করতেন, এত বড় নদী একটু দখল হলে কীই-বা আর ক্ষতি হবে, দূষণ হলেও বা ক্ষতি কি? কারো কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে নদী দখল এবং দূষণমুক্ত করার কথা বললেও তাদের নেতারাই দখল দূষণে মেতে ওঠে। তারপরেও দিবসের গুরুত্ব রয়েছে। নদী দিবস পালনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নদী সম্পর্কে তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য স্মরণ করানো এবং নদীর বর্তমান অবস্থাকে তুলে ধরে একটি কার্যকর চাপ তৈরি করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতি বছরই কিছু না কিছু নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যদিও এর গতি মন্থর। তারপরও কিছু তো হচ্ছে। আওয়াজ তো হচ্ছে, আওয়াজ যদি না থাকত, তাহলে নদীর দুরবস্থা আরও ত্বরান্বিত হতো। দিবস পালন করতে গিয়ে সারাদেশে নদীসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জনপরিসরে আলোচিত হয় এবং জনমত তৈরি হয়। এর সুফল পায় আমাদের নদীগুলো। সে অর্থে দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম।
বর্তমানে আমাদের মানসিকতা এমন হয়েছে উন্নয়ন মানেই বোঝে রাস্তা, ঘাট, পুল ব্রিজ, বিল্ডিং বানানো ইত্যাদি। উন্নয়ন বলতে সরকারি দলের লোকরাও তো একই কথা বোঝে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি উন্নয়নের নামে নদীসহ পরিবেশদূষণকারী বিষয়গুলোর ব্যাপারে খড়গহস্ত হওয়া যেত, তাহলে তো আমজনতার বোঝা না-বোঝাকে অগ্রাহ্য করেই আমরা আমাদের নদীগুলো বাঁচাতে পারতাম। নদীর পাড় দিয়েই প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা। পানি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই পানির সবচেয়ে ভালো উৎস হিসেবে নদীকেই বেছে নিয়েছিল প্রাচীনকালের মানুষ। কিন্তু সেই সভ্যতার খাঁড়ায়ই বিলীন হতে চলেছে নদী। উন্নয়নের নামে অযথা নদীর টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে বলে অনেক সময় নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আর নদীকে নালা হিসেবে ব্যবহার করার কথা কে না জানে। নদীর প্রতি অনিষ্টকর আচরণের কয়েকটির কথা বলা যাক। আমরা দেখেছি মেডিকেল বর্জ্য, গৃহবর্জ্য ইত্যাদির অনেকটাই নিক্ষেপ করা হচ্ছে নদী নামক ভাগাড়ে। আবার দেখছি উন্নত রাষ্ট্রের পারমাণবিক মহড়ার জন্য বেছে নেয় সাগর ও নদী, নদী হয়ে উঠছে মশা-মাছির প্রজননের আদর্শ স্থান। কেউ কি খেয়াল করেছেন, নদীর পাড় কিংবা নদীতে জেগে ওঠা চর হামেশাই দখল হয়ে যাচ্ছে? প্রথমে কোনো সমিতির সাইনবোর্ড, রাজনৈতিক দলের কার্যালয় লাগিয়ে দখল শুরু হয়ে যায়। এরপর সেখানে দালান ওঠে। নদীর ধারে এই অবৈধ কারবার দিনের পর দিন চলে, কিন্তু কেউ তাদের কোনো শাস্তি দেয় না। নদীকে আড়াআড়ি রেখে রাস্তা তৈরি করে নদীর সর্বনাশও ডেকে আনা হয়। সড়ক মানেই যে উন্নয়ন নয়, সড়ক নির্মাণের সময়ও যে প্রকৃতি-পরিবেশের কথা বিবেচনায় নিতে হয়, সে কথা কে কাকে মনে করিয়ে দেবে?
দেশের সব রাজনৈতিক দল, যে দলই ক্ষমতায় যায় তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই এবং যারা বিরোধী দলে থাকে বা ক্ষমতায় যেতে পারে না তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে মেতে ওঠে। কিন্তু কোনো দলকেই দেখা যায়নি নদী নিয়ে ভাবতে, নদী সুরক্ষা নিয়ে কথা বলতে, যাও বলছে ক্ষমতাসীন লোকরা বলার কথা বলে, কাজে বা বাস্তবে ঘোড়ার ডিম, বরং উল্টো ক্ষমতায় গেলে তারাই দখল বাণিজ্যে মেতে ওঠে। নদীকে ঘিরে সভ্যতা গড়ে উঠেছে- এটা সত্য। নদীর পাড়ে ইন্ডাস্ট্রি হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে, শহর হবে, সড়ক হবে সবই ঠিক আছে। সেগুলো হবে নদীকে রক্ষা করে কিন্তু নদীকে ধ্বংস করে নয়। নদী দখলে যে শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি তা নয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), প্রভাবশালীরা ও স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের নদীগুলো ধ্বংস হওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
নদী রক্ষার জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে। নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সেখানে থাকবে না কোনো স্বজনপ্রীতি, থাকবে না কোনো রাজনৈতিক প্রভাব।
নদী সুরক্ষায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে, নদীকে মুক্তভাবে চলতে দিতে হবে, নদী নির্ভর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নদীর অর্থনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে, নদীর প্রতিবেশগত ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে, নদীর পুনরুজ্জীবনের জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, নদী রক্ষায় জিরো টলারেন্স মনোভাব থাকতে হবে, নদী সুরক্ষার সুফল এবং দখল দূষণের কুফল সম্পর্কে স্থানীয় পর্যায় সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, স্থানীয় পরিষদকে শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়াও, আমাদের নদীগুলো কোথায় আছে, কেমন আছে তা আমাদের জানতে হবে, মানুষকে জানাতে হবে।
পরিশেষে, জীবন্ত প্রাণকে হত্যা করা যেমন অপরাধ, মাকে হত্যা করা আরও বেশি অপরাধ। একাধিক জীবন্ত প্রাণিকে হত্যা করলে যেমন গণহত্যার শামিল তেমনি নদীকে হত্যা করাও গণহত্যার শামিল। আসুন নিজেদের জন্য, জীবিকার জন্য, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য, নদী মাতৃক দেশের ঐতিহ্য ফিরে আনার জন্য সম্মিলিতভাবে নদী রক্ষায় এগিয়ে আসি।
শফিকুল ইসলাম খোকন : কলাম লেখক