শ্রমিকস্বার্থ রক্ষা করুন

প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সুমাইয়া আকতার ঢাকা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠার আরেক করুণ দৃষ্টিপাত হয় চা-শ্রমিকদের জীবনে। বর্তমানে চা বাগানের ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন অস্থায়ী শ্রমিকের জীবনই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত, নিপীড়িত এবং মজুরি বৈষম্যের শিকার। অথচ প্রতিবছর মে দিবস এলেই শ্রম আর শ্রমিকের নায্য অধিকার ও বৈষম্য নিরসন করার বিষয়ে লেখালেখি হয়, সভা-সমাবেশ হয়। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকদের বহু বছর যাবত শোষণ ও বঞ্চনা নিরসনের কার্যকরী পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচরহীন। সমান কাজে সমান মজুরি দেওয়ার আইন থাকলেও চা-শ্রমিকদের আজও ক্লাস/ক্যাটাগরির নামে 'এ' 'বি' ও 'সি' করে যথাক্রমে ১৭০ টাকা, ১৬৯ টাকা ও ১৬৮ টাকা দৈনিক মজুরি দেওয়া হচ্ছে। অথচ 'বি' ও 'সি' ক্লাস বাগানের শ্রমিকদের কাজের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকে। এ ছাড়া সমান কাজ করলেও ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের মজুরি অনেক ক্ষেত্রে কম দেওয়া হয়। আবার পুরুষ শ্রমিকদের স্ত্রীকে তাদের ওপর নির্ভরশীল বিবেচনা করে রেশন দেওয়া হলেও নারী শ্রমিকের বেকার স্বামীকে নির্ভরশীল বিবেচনা করা হয় না। তাদের দেওয়া হয় না রেশনও। যুগ যুগ ধরে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে এই অন্যায় চলে আসছে। এর ওপর যোগ হয় আবাসন, শিশুযত্ন, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য ভাতা। কিন্তু কাগজে লেখা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব সুবিধা তারা পান না। বর্তমান বাংলাদেশের সবকিছু ঊর্ধ্বগতির বাজারের সঙ্গে এই মজুরি কতটুকু বাস্তবসম্মত? শ্রমিকদের ৯৭ শতাংশেরই স্বাস্থ্যসম্মত কোনো প্রক্ষালন ব্যবস্থা নেই, সন্তান দিবা পরিচর্যা কেন্দ্রের সুবিধা নেই ৬৮ শতাংশের, আর শারীরিক, মৌখিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া তো সেখানকার নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে একেবারেই নিয়মিত ঘটনা। অন্যদিকে পুষ্টি, শিক্ষা, সাধারণ স্বাস্থ্য সুবিধা ইত্যাদির মতো মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতিও যেন অবহেলিত। সারাদেশে কর্মরত চা-শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার। মৌলভীবাজার জেলায় মোট ৯২টি চা বাগানের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার নিয়মিত চা-শ্রমিক কাজ করেন এই জেলায়। তাদের সিংহ ভাগই নারী। নারীর সমান অধিকার আজও যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে এই সিংহভাগ নারীর নায্য অধিকারে। নারী শ্রমিক পারভীন বেগম ও শেফালি কর বলেন, পেটের দায়ে যখন যে কাজ পাই, সেটা করতে আমরা বাধ্য হই। এরপরও দেড়শ কিংবা দুইশ টাকা রোজ দেওয়া হয়। এটি দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। আর পুরুষরা কাজ করলেই তিন থেকে চারশ টাকা পান। আমরাও পুরুষদের চেয়ে কাজ কম করি না। তবে পারিশ্রমিক কম পাই। 'নারী অধিকার ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন একসূত্রে গাঁথা' এই চেতনায় টিআইবি প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করছে। বাস্তবিক ক্ষেত্রে এই সিংহভাগ নারী শ্রমিকই সবচেয়ে বেশি এখন দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও কেন নারী শ্রমিকের অধিকার ব্যানারে শোভা পায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নয়, সেটাই প্রশ্ন। দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে ২০২২ সালের আগস্টে ধর্মঘট করেছিল চা-শ্রমিকরা। সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট চা-শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। চা-শ্রমিকের মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করে। মজুরি বোর্ডের জন্য একটি লজ্জার বিষয় হলো, তারা মজুরি কাঠামো নিয়ে চা-শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য সুপারিশ তৈরি ও উপস্থাপন করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। চা-শিল্পে নিম্নতম মজুরি বোর্ড অনিয়মিত ও চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে এ পর্যন্ত তিনবার বোর্ড গঠন করেছে। তবে এর ভূমিকা কখনো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কারণ, বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে সই হওয়া শ্রম চুক্তি মোতাবেকই এতদিন মজুরি ঠিক হয়েছে। সর্বশেষ সই হওয়া শ্রম চুক্তির মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে এবং ২০২১-২০২২ সময়কাল ও পরবর্তী দুই বছরের জন্য (যা চলমান) কোনো শ্রম চুক্তি এখনো সই হয়নি। মজুরি বোর্ডের অসঙ্গতি ও বিটিএর একগুঁয়েমির কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার শ্রম আইনের মধ্যে থেকে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিল। চা-শিল্প ও শ্রমিকদের বেলায় মালিকরা যে শুধু শ্রম আইনই অনুসরণ করেন, এমন নয়। দীর্ঘদিন ধরে চা-বাগানে প্রচলিত দস্তুর বা প্রথাও তারা অনুসরণ করেন, যা শ্রম আইনে স্বীকৃত। নিম্নতম মজুরি বোর্ড ২০১০ সালের গেজেটে স্পষ্টভাবে উলেস্নখ করেছে যে, 'চা-শিল্পের বহু বছরের প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুযায়ী টি-গার্ডেন শিল্প সেক্টরের চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ চা সংসদ প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর মজুরি ছাড়াও উৎপাদনশীলতাসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।' প্রথা চলমান থাকুক- এমনটাই চান রামভজন কৈরীসহ আরও অনেকেই। তবে ১০ আগস্টের গেজেট সুস্পষ্টভাবে বলছে যে, নিম্নতম মজুরি বোর্ড মালিকদের ইচ্ছাকেই শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। কারণ, চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের একরকম উপেক্ষা করা হয়েছে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।' চা-বাগানে একটি কম আলোচিত বিষয় হলো-কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশ (৫ শতাংশ)। চা বাগানের মালিকরা কখনোই চা-শ্রমিকদের এই লভ্যাংশ দেননি। এখন নিম্নতম মজুরি বোর্ড গার্মেন্ট সেক্টরের মুনাফা দেওয়ার ব্যবস্থা চা-শিল্পে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি আরেকটি উদ্যোগের বিষয় হলো-চা শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি থেকে বঞ্চিত করা। যা শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বরং গ্র্যাচুইটির পরিবর্তে যে পেনশন পান, তা গ্র্যাচুইটির তুলনায় অনেক কম। সপ্তাহে ২৫০ টাকা (২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা), যা ২০২০ সাল পর্যন্ত ছিল ১৫০ টাকা এবং ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ২০ টাকা। গ্র্যাচুইটির বিষয়টি চাতুরতার সঙ্গে এড়াতে মালিকপক্ষ বলছে, শ্রমিকদের অবসর গ্রহণের পর তাদের ঘর ছাড়তে হয় না। চা-শ্রমিকরা, যাদের পূর্বপুরুষ চা-বাগানে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে এসেছিলেন, যেভাবে এখনো এখানে বন্দি জীবনযাপন করছেন, ঠিক সেভাবেই বাকি শ্রমিকদেরও কুণ্ঠিত করছেন মালিকপক্ষ। এ ছাড়াও ৯৭ শতাংশ চা-শ্রমিকদের নেই কোনো স্থায়ী নিয়োগপত্র। স্থায়ী নিয়োগপত্র ছাড়াই নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। পক্ষান্তরে, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের দিকে তাকালে দেখা যায়, উন্নয়নের নামে ও কাজে নিজেদের আত্মীয়স্বজন, স্বগোত্রীয় ও স্বশ্রেণির মানুষের জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যন্ত গ্রামের, পাহাড়ের, হাওড়ের, কৈবর্তপাড়ার, মুচিপলস্নীর, কামারশালার তথা নিম্ন আয়ের, নিম্ন পেশার, নিম্ন শ্রেণির প্রান্তিক মানুষরা কি তাহলে রাষ্ট্র স্বীকৃত সুবিধা প্রাপ্তিযোগ্যদের তালিকায় পড়েনি। যদি পড়ে, তাহলে যে সুবিধাভোগীদের খাতায় উলেস্নখিত প্রান্তিক মানুষ বরাবর প্রান্তিকই রয়ে যাচ্ছে, তার ব্যাখ্যা চায় বর্তমান সমাজ। ওই যে সুবিধাভোগীদের পদভারে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, তাদের কণ্ঠের দরাজ শব্দে সব টেলিভিশনের পর্দা, তাদের গগণবিদারী আওয়াজে সব জনপদ নিরন্তর প্রকম্পিত হয়ে উঠছে, সেখানে শেষোক্ত ওই প্রান্তিক মানুষ নেই কেন? কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চা-শ্রমিকদের উত্তরসূরিদের মজুরি নিয়ে আজও রাস্তায় নামতে হয়, তাই রাষ্ট্র সংস্কারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। কেন গরিব শুধু গরিব আর ধনী শুধু ধনী হওয়ার সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করছে, তা এখন প্রকাশ্য। ১০ শতাংশ বিত্তবান দেশের মোট আয়ের ৪২ শতাংশ দখল করে আছে। স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর পরও যদি ৯৬ শতাংশ চা-শ্রমিক স্থায়ী নিয়োগপত্র না পান, ৯৭ শতাংশের স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্ষালন সুবিধা না থাকে, ৬৮ শতাংশ নারী শ্রমিক দিবাভাগে কর্মরত অবস্থায় সন্তান পরিচর্যার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, অধিকাংশ নারী শ্রমিক ক্রীতদাস-দাসীর মতো অহরহ শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে বুঝতে হবে, সংবিধানে উলেস্নখিত 'জনগণের অনগ্রসরের একটা বড় অংশকেই এখন বর্তমান সংস্কারের দিকে এগিয়ে নিতে হবে খুব দ্রম্নত। রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে এবং সংস্কারে এই প্রান্তিক গোষ্ঠীর আহাজারি, অধিকার ও শ্রম শোষণের দিকে দৃষ্টিপাত করে বাংলাদেশকে আরও গতিময়তার দিক প্রশস্ত করতে হবে। সুমাইয়া আকতার ঢাকা