ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ক্রান্তিকালে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাওয়ালীর আসর হয়, গণবিবাহ হয়, স্বৈরাচারের চলিস্নশা হয়- তাতে কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত সেই-বিদ্যার্জন, জ্ঞান অন্বেষণ এবং জ্ঞান চর্চা স্থবির হয়ে আছে। সাম্প্রতিক গণঅভু্যত্থানের পরে দেশ গড়ে তোলার প্রশ্নটা জরুরি। সবাই সে মত ব্যক্ত করছে। প্রত্যাশাও করছে। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, পররাষ্ট্র ও শিল্পনীতি বিষয়ক পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতির সামনে হাজির করবে। সভা, সেমিনারে আলোচনায় সরগরম থাকার কথা ছিল। যে বৈষম্য নিরসনের বার্তা দিয়ে ছাত্ররা জীবন বাজি রেখে নিঃশঙ্কচিত্তে লড়ে গেছে। সেই বৈষম্য রোধের উপায় কী? শিক্ষায় বৈষম্য থাকবে কি, থাকবে না। সেসব বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ছুড়ে ফেলে উন্মাদনার আলোচনাই খবর হচ্ছে বারংবার। অর্থাৎ ট্রেন উল্টো পথে পরিচালিত হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে দরজায় কড়া নাড়ছে-'শিক্ষা দিবস'।
শিক্ষা দিবস নিছক কোনো দিবস নয়। এর তাৎপর্য এবং গুরুত্ব সুবিশাল। জনতার কণ্ঠরোধ এবং পথ রোধের আয়োজন নিশ্চিত করে স্বৈরাচার। দিশাহীন জাতির সামনে আশার আলো নিয়ে হাজির শিক্ষর্থীরা। সু-উচ্চস্বরে দেশবাসীকে জানিয়ে দেয় শিক্ষার কথা, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা। সর্বোপরি দেশের মানুষের মুক্তির কথা। স্বৈরশাসন দেশবাসীকে কোণঠাসা ও অনুগত করার জন্য প্রথমেই আক্রমণ চালায় শিক্ষার ওপর। কারণ চিন্তাকে শৃঙ্খলিত করতে পারলে সহজেই দেশের মানুষকে শাসন করা যায়। ইংরেজদের শাসনের এমন কুৎসিত কায়দা সব স্বৈরশাসনই রপ্ত করেছে। স্বৈরাচার আইয়ুব খান তার ক্ষমতা দখলের দুই মাসের মাথায় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে- তৎকালীন শিক্ষা সচিব এসএম শরীফের নেতৃত্বে। যা পরে শরীফ কমিশন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ করো মতামত না নিয়ে তড়িঘড়ি করে কমিশন রিপোর্ট পেশ করেন। এবং প্রস্তাবনা হাজির করেন। যা শিক্ষায় বৈষম্য বৃদ্ধিকে স্থায়িত্ব দেবে। সেজন্য একে শিক্ষা সংকোচননীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কমিশন তার প্রস্তাবনায় 'শিক্ষাকে শুধু ধনীদের জন্য সংরক্ষণের কথা বলেন। এ ছাড়া কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখার প্রস্তাব করেন। এবং বাংলা বর্ণমালার সংস্কারের প্রস্তাব করেন।'
শরীফ কমিশনের চাপিয়ে দেওয়া অগণতান্ত্রিক বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি ছাত্রসমাজ গ্রহণ করতে চায়নি। ফলে প্রতিরোধের মশাল জ্বলে ওঠে। ছাত্ররা রাজপথে প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সারাদেশে হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। হরতাল সফল করতে সকালবেলার সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সমাবেশে ছাত্রদের সঙ্গে শত শত সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। সমাবেশ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয়। এ পর্যায়ে পুলিশ হাইকোর্টের মোড়ে বাধা সৃষ্টি করে। মিছিলকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে বিকল্প পথে মিছিলে যাত্রা শুরু করে। এমতাবস্থায় পুলিশ পেছন থেকে প্রথমে টিয়ারশেল, পরে গুলিবর্ষণ করে। সেই গুলিতে মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউলস্নাহ নিহত হন। সরকারি হিসেবে ৭৩ জন আহত, ৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় বিদ্রোহের আগুন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সুন্দর আলী নামে একজন শ্রমিক। সারাদেশের আন্দোলনের চাপে আইয়ুবের সরকার গণবিরোধী নীতি প্রত্যাহার করে। শিক্ষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে এটা ছিল-প্রথম বিজয়। তারপর থেকে এই দিবসটি বাংলাদেশের শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
শিক্ষা দিবসের তাৎপর্য সর্বস্তরের নিয়ে যাওয়ার আয়োজনটা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও সম্ভব হয়নি। সম্ভব না-হওয়ার বড় কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। যারাই যখন ক্ষমতায় গিয়েছে শিক্ষানীতিকে তাদের শাসনের উপযোগী করে পরিচালিত করেছে। কিন্তু শিক্ষায় বৈষম্য বিলুপ্ত করার পরিকল্পনা জাতির সামনে হাজির করেনি। বরং নতুন করে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। শিক্ষাকে তেল, নুন, চাল, ডালের মতো বাজারি পণ্যে পরিণত করেছে। টাকা ছাড়াও শিক্ষা অর্জন করো। টাকা নাই তো শিক্ষা নাই। আবার শিক্ষা পেলেও কর্মসংস্থান নেই। ফলে জন্ম নিয়েছে বাজারমুখী চাহিদার তত্ত্ব। অর্থাৎ বাজারে চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করলে-কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। ফলে শিক্ষা উদ্দেশ্যের বিপরীতে পরিচালিত হচ্ছে।
সদ্যবিদায়ী স্বৈরাচারের কালে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক অধঃপতন হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহোৎসব, কোচিং বাণিজ্য, পাঠ্যপুস্তকের চৌর্য্যবৃত্তি এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। ফলে তরুণ মনে কায়দা করে পরীক্ষা পাস করার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। অধ্যবসায়, জ্ঞান জগতের বিস্তৃতি, উন্নত রুচি-বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার চিন্তা করার পথ রূদ্ধ হয়েছে। যুব সমাজকে এক নির্লিপ্ত জাতিতে পরিণত করার সব রকম পাঁয়তারা করেছে তারা। এমতবস্থায় ৫ আগস্ট জাতীয় জাগরন ঘটেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর।
দেহের বিকাশ প্রাণী জগতের স্বাভাবিক প্রবণতা। মনের বিকাশ সাধনে জন্য শিক্ষার্জন করতে হয়। সেজন্য মন বা চিন্তা করার ক্ষমতা শুধু মানুষেরই বিদ্যমান। এখানেই প্রাণী থেকে মানুষ স্বতন্ত্র। ফলে একজন মানুষকে শিক্ষাবঞ্চিত করার অর্থ হচ্ছে তাকে মানুষের স্তর থেকে পেছনে ঠেলে দেওয়া। সেজন্য প্রয়োজন সর্বজনীন শিক্ষা। আগামীর বাংলাদেশে 'শিক্ষা দিবসের' চেতনার ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে পারলেই- সোনার বাংলা ফুলে, ফলে বিকশিত ও সুসজ্জিত করা সম্ভব। এখন সময় এসেছে নতুন চিন্তায় নতুনভাবে শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার। সে পথ প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রাখবে এটাই জাতির প্রত্যাশা।
রিয়াজ মাহমুদ
ঢাকা