জনমনে স্বস্তি বজায় থাকুক
রাজনৈতিক দলকে দূরে রেখে কি রাষ্ট্র সংস্কার করা সম্ভব? আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা চাই জনমনে স্বস্তি ফিরে আসুক। এখন দেশের মানুষ স্বৈরাচারী শাসনমুক্ত একটি পরিবেশে প্রাণ খুলে কথা বলছে। নিজের দুঃখ-কষ্ট চাওয়া-পাওয়ার কথা খুলে বলতে পারছে- যা আগে পারেনি। এখন কারও মনে যেন অস্বস্তি দানা বেঁধে না ওঠে। এখনও যদি স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনের সময়কার মতো অস্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, সেটা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক।
প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রেজাউল করিম খোকন
দেশ এখন কোন পথে এগোচ্ছে? আজকাল অনেকেই প্রশ্ন করেন। দীর্ঘ ১৬ বছরের একটানা দুঃসহ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা সাধারণ ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বিরাট বিজয়। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল দেশের আপামর জনসাধারণ। নিপীড়ন, নির্যাতন, পৈশাচিকতা, নির্মমতা চালিয়ে বারবার দমন করা হয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হয়নি পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের। তাদের পালিয়ে যেতে হয়েছে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের পর দুই মাস সময়ও পার হয়নি। সবার আকাঙ্ক্ষার ফসল হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। এই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম নিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের একটানা শাসনামলে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে দেশের প্রশাসন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ব্যবসাবাণিজ্য, ব্যাংক ব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবই। এত দীর্ঘ সময়ের আবর্জনা এক-দুই মাসে পরিষ্কার করে ফেলা মোটেও সম্ভব নয়। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ইতিবাচক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। তারা সংস্কার কার্যক্রম শুরুর জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আমরা সাধারণ মানুষ চাই, সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে যত দিন প্রয়োজন, তত দিন ক্ষমতায় থাকুক অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। ফ্যাসিস্ট, অত্যাচারী, নিপীড়ক শেখ হাসিনার দোসররা এ দেশের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল। আমাদের বসবাস যেন ছিল জেলখানায়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে হয়তো হটানো হয়েছে, কিন্তু তার অপকর্মের কারণে বিপর্যয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে যাওয়া বাংলাদেশকে সংস্কার দুই-তিন মাসে সম্ভব নয়। এটা আমাদের বুঝতে হবে। দেশের সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে মাত্র। আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে এজন্য। আগামীর বাংলাদেশ হবে সুশাসনের বাংলাদেশ। দখলদারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দাম্ভিকতা, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বর্বরতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতা দেখানোর প্রচেষ্টার রাজনীতি চিরতরে উচ্ছেদ করতে হবে। মানুষ ক্ষমতা একজনের হাতে দেখতে চায় না। তারা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চায়। শিক্ষাঙ্গনে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি কোনোভাবেই থাকতে পারবে না। ছাত্রদের কল্যাণেই ক্যাম্পাসে সব রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালিত হবে। তারুণ্যের কোনো দলমত নেই। তারা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চায়, তারা সুশাসনের বাংলাদেশ চায়। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের অপকর্ম, অপরাধের বিচার করতে হবে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আগামী দিনগুলোতে আর কেউ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার দুঃসাহস না পায়। অন্তর্র্বর্তী সরকারের সফলতার ওপর দেশের আগামীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই সরকার সফল হলে দেশের মানুষের জন্য ভালো হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশের মানুষকে ভুগতে হবে। তাই সরকারকে সফল করার জন্য সবার সহযোগিতা করা উচিত।
বাজারে এখনো চালের দাম বাড়তির দিকে। চালের পাশাপাশি বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের দামও। দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথম যে পদক্ষেপটি নিতে হয়, সেটি হলো চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, বিকল্প ব্যবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশেই রেশনিং ব্যবস্থা আছে, যেখানে সরকার বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রি করে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বাজার সিন্ডিকেটের দোহাই দেওয়া হতো। ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক কিছু বদল হলেও বাজার সিন্ডিকেটের প্রভাব এতটুকু কমেছে, এর প্রমাণ নেই। পরিবহণে চাঁদাবাজিও কমেনি, যদিও চাঁদাবাজদের চেহারা বদল হয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর বড় বড় সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। এসব সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম সীমিত আয়ের মানুষের নাগালে না রাখতে পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাজার নিয়ন্ত্রণে চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ সরকার নেয়নি। বাজার ব্যবস্থাপনা চলছে আগের মতোই। কয়েক মাসের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে। কিন্তু গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে সেই কয়েক মাস অপেক্ষা করা সম্ভব কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। চাল, ডাল, আটা ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যগুলো যাতে তারা সাশ্রয়ী দামে কিনতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। জ্বালানির দাম কিছুটা কমায় কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহণ খরচ কমবে আশা করা যায়। বিচ্ছিন্ন ও লোক দেখানো কর্মসূচি নয়, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নিতে হবে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ করে বড় বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশ করা নিয়মিত ঘটনা ছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ দাবি আদায় করতে সড়ক অবরোধ ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েছেন। সরকার সচিবালয়কে কেন্দ্র করে সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ চলছেই। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর প্রত্যাশী তরুণরা সড়ক অবরোধ করে রেখেছিলেন। এই অবরোধের কারণে পুরো ঢাকা শহরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এর পর সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এতে পুরো শহরই হয়ে পড়ে স্থবির। আন্দোলন তথা অবরোধের কারণে কোনো সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলে সারা শহরের জনজীবন অসহনীয় হয়ে পড়ে। দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে সরে না এলে জনদুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে। জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের ন্যায়সংগত যে কোনো দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধের চেয়ে উচিত যৌক্তিক পথ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা তুলে ধরা। বর্তমানে দেশে একটি অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। যৌক্তিক যে কোনো দাবি তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে, এমন একটি আশাবাদ তৈরি হয়েছে। জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের শিক্ষার্থীদের উচিত তাদের দাবি-দাওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট জমা আছে আমাদের। সেটা আমরা সবাই কম-বেশি বুঝি। এখন যদি অন্তর্র্বর্তী সরকারকে কাজ করতে দেওয়া না হয়, তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। তাদের কাজ করতে দিতে হবে। ঘেরাও করে কাজে বাধা দেওয়া চলবে না। এ ছাড়া সড়ক অবরোধ, সড়কে মিছিল, মানববন্ধন না করার জন্য একাধিকবার পরিপত্রও জারি করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের দমবন্ধ অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে, জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এর অর্থ এই নয় যে, দেড় মাস বয়সি অন্তর্র্বর্তী সরকারের ওপর দাবির পাহাড় চাপিয়ে দিতে হবে। দাবি আদায়ের নামে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত করতে হবে। যে কোনো জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করি। কিন্তু সে জন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারকে যেমন সময় দিতে হবে, তেমনি আন্দোলনের নামে জনগণকে কষ্ট দেওয়া বা জনজীবনকে অচল করা যাবে না। অন্তর্র্বর্তী সরকারের যে মূল কাজ রাষ্ট্র সংস্কার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, সে জন্য তো তাদের সময় দিতে হবে। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে কোনো সংগঠন বা সম্প্রদায় দাবি আদায়ের জন্য অবরোধ ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি নেবে না। আর এই দাবি আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে, সেটা হলো আলোচনা, স্মারকলিপি প্রদান। সরকারও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সেল গঠন করতে পারে, যারা দাবি উত্থাপনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। কোনোভাবে ঘেরাও বা সড়ক অবরোধ দাবি আদায়ের মাধ্যম হতে পারে না।
ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য অপরাধ ঘিরে যেসব মামলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণহীন বলে অভিযোগ উঠেছে। হত্যা কিংবা অন্য কোনো ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে নূ্যনতম নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি। এসব ঢালাও মামলা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা দিয়েছে তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে বিগত সরকার যে চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছিল, তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু বিচারের নামে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার অধিকার কারও নেই। ঢালাও মামলায় জড়ানোটা আওয়ামী লীগ আমলের গায়েবি মামলার সঙ্গেও তুলনা করা যায়। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনার পর আমাদের প্রত্যাশা, ঢালাও মামলায় আর কাউকে অযথা আসামি করা হবে না। আমরা চাই হত্যা, দুর্নীতিসহ সব অপরাধের বিচার হোক। কিন্তু অপরাধীকে শনাক্ত না করে এ রকম গয়রহ মামলা করলে যেমন নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হবেন, তেমনি ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ হবে।
শিল্পাঞ্চলে সাম্প্র্রতিক শ্রমিক অসন্তোষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা ও অশান্তি যেন কাটছেই না। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন কারখানার সামনে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি, বেতনসহ সমানুপাতিক হারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে কয়েকটি কারণ ওঠে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কারখানা-মালিকদের অনেকে সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের কারখানাগুলোর শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঝুট ব্যবসাশ্রমিক বিরোধ। আগে সেই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এখন সেই ব্যবসা দখল নিতে চায় তাদের বিরোধীপক্ষ। কেউ কেউ মনে করছেন, তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিক অস্থিরতায় ইন্ধন দিচ্ছে। একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি-দাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। অনেক দাবি মালিকরা মেনেও নিয়েছেন। এরপরও বিক্ষোভ থামছে না। ব্যবসায়ীরা শিল্পাঞ্চলে ভাঙচুর ও লুট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ও ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, কেবল প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করা যাবে না। তাদের নূ্যনতম ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি সুন্দর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় পক্ষের কোনো ইন্ধন থাকলে তা অনুসন্ধান করে দেখা হোক। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এর ওপর লাখো শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কোনো অসন্তোষ দেখা দিলে প্রতিযোগী রপ্তানিকারক দেশগুলো এর সুযোগ নেবে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ সেই চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করে রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়, এরই মধ্যে তাদের মদতে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে। অতএব, সরকারকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্রম্নত শিল্পাঞ্চলে শান্তি ও নিরাপদ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শ্রমিকদেরও বুঝতে হবে, কারখানা বন্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজেদেরও ক্ষতি হবে। আন্দোলন হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস। কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে দেওয়া যাবে না। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে গিয়ে মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান অবশ্যই বের করতে হবে। আমরা আশা করব, অবিলম্বে শিল্পাঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়, এমন কোনো কাজ কোনো পক্ষ করবে না।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভু্যত্থান পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দাবি আদায়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঠে নামা, শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক সংকটের ওপর যেমন আলোকপাত করেছেন, তেমনি পরিস্থিতি উন্নয়নে এক মাসে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি রূপকল্প তুলে ধরেছেন। প্রধান উপদেষ্টা আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো ও ঋণ পরিশোধের ওপর জোর দিয়েছেন। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনানুগ ও বাস্তববাদী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। খোলামনে সমালোচনা করার জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর আগে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন, সংবাদমাধ্যমকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। আমরা মনে করি, সংবাদমাধ্যমের কাজই হলো ক্ষমতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করা। সেই প্রশ্ন যত বেশি তীক্ষ্ন ও তীব্র হবে, সুশাসনের পথ তত প্রশস্ত হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অশুভ তৎপরতা থেকে দেশকে মুক্ত করার যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তাতে সর্বস্তরের মানুষের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ভবিষ্যতে ভোটের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় আসুন না কেন, তার বিষয়টি মনে রাখবেন আশা করি। নির্বাচনে জয়ী হওয়া মানে স্বেচ্ছাচারিতার অবাধ ছাড়পত্র নয়। গত এক মাসে সরকারের কর্মকান্ডে এক ধরনের জবাবদিহির প্রতিফলন রয়েছে। একই সঙ্গে জনমনে আশাবাদ তৈরি ও একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষাকে জোরদার করেছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সেই সংস্কার কীভাবে হবে, কারা করবেন ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন ছিল। প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। কমিশনগুলোর প্রধান হিসেবে যাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ। এসব কমিশন ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশা করা যায়। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে কমিশন প্রতিবেদন দেবে এবং এর ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ সভার আয়োজন করবে। সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করার আগে ছাত্রসমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক পরামর্শ করা হবে। আইন সংবিধান সংস্কার হলেই শুধু হবে না, এসব বাস্তবায়ন করতে হবে। মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলকে দূরে রেখে কি রাষ্ট্র সংস্কার করা সম্ভব? আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা চাই জনমনে স্বস্তি ফিরে আসুক। এখন দেশের মানুষ স্বৈরাচারী শাসনমুক্ত একটি পরিবেশে প্রাণ খুলে কথা বলছে। নিজের দুঃখ-কষ্ট চাওয়া-পাওয়ার কথা খুলে বলতে পারছে- যা আগে পারেনি। এখন কারও মনে যেন অস্বস্তি দানা বেঁধে না ওঠে। এখনও যদি স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনের সময়কার মতো অস্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, সেটা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক।
রেজাউল করিম খোকন :অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক