গণতন্ত্র অর্থ- জনগণের শাসন। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। সেই প্রতিনিধি সংসদে বা পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নসহ তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা তুলে ধরেন এবং সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেন। সংসদীয় বিধি ব্যবস্থায় এটাই নিয়ম। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের বিকল্প কিছু নেই। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা, রীতিনীতি। পৃথিবীতে উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠান হয় নিয়ম অনুযায়ী। সেখানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে কোনো সরকার থাকে না। কারণ সেখানে রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত বিশ্বাসের ভিতগুলো খুবই শক্ত বা পোক্ত থাকে। নির্বাহী বিভাগগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং নির্বাহী বিভাগগুলো তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকে। রাষ্ট্রের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের উন্নয়নের বিভিন্ন ফিরিস্তি জনগণের সামনে হাজির করে। জনগণ এর মধ্যে পূর্বাপর বিচার-বিশ্লেষণ করে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য মনস্থির করে। তবে বিশ্বাসের যদি কোথাও ঘাটতি থাকে সেখানে গণতন্ত্র রুগ্ন হয়ে যায়। যেমন- ভারত পৃথিবীতে একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। তাছাড়া সেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোয় দেশ চলে। নির্ধারিত সময়ে সরকার পরিবর্তন হয় ভোটের মাধ্যমে। নির্বাচনী ব্যবস্থা অত্যন্ত স্বচ্ছ। বিভিন্ন প্রদেশে ভোট হলে ভোটের বাক্স গণনার জন্য একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় ভোটের গণনার অপেক্ষায়। যেহেতু বিশাল দেশ ভারত। সেখানে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে ঈশ্বরের একটা কথা মনে পড়ে গেল, 'যেভাবে যে ভজে মোরে পায় সেই ভাবে।' অর্থাৎ আমাকে তোমরা যেভাবে ভজনা করবে আমি সেইভাবে তোমাদের ধরা দেব। এটা এ জন্যই বললাম, এই যে ভোটের বাক্স তালাবদ্ধ অবস্থায় একটা ঘরে রাখা হয়, যা নির্ধারিত দিনে খুলে গণনার জন্য দেওয়া হয়। অনেক দেশে এই লক রাতের অন্ধকারে আনলক হয়ে যায়। পরিবর্তন আসে শরীরী কাঠামোয়। অন্ধকারে চোর চুরি করবেই। এটাতো অন্ধকার গণতন্ত্রের সংকুচিত ও বিপজ্জনক পথ। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা। আর যারা প্রতারণা করেন তারা চোরতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। এরা ভালো শাসক হয় না। তাদের সময়ে দেশের জনগণ অনেক কষ্টে থাকেন। এটা প্রতারক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। আবার অনেক দেশে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে ব্যবহার করে ভোটের ফল পাল্টিয়ে দেয় জোর করেই। আবার অনেক দেশে জোর করে সেনাশাসকরা ক্ষমতা দখল করে। প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তান, মিয়ানমার। জনগণ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে জীবন নির্বাহ করেন। কারণ তারা শাসনের আড়ালে সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যতিব্যস্ত থাকেন সব সময়। রক্ত চোষার মতো দেশের সম্পদ চুষে নেন। এটাকে গণতন্ত্র না বলে স্বৈরতন্ত্র বলা যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের আড়ালেও অনেক দেশে স্বৈরতন্ত্র দেখা যায়। তাই স্বেচ্ছাচারী শাসকগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রে নিজেদের লোকজন বসিয়ে গণতন্ত্রের আড়ালে দমন-পীড়নের মাধ্যমে অত্যন্ত সুকৌশলে সম্পদ লুণ্ঠন করে থাকে একনায়কতন্ত্রের মতো। এতে করে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। অবর্ণনীয় কষ্টে থাকে দেশের জনগণ। পুুঁজিবাদী গণতন্ত্রে অনেক দেশে এই চোর-পুলিশ খেলা অনুষ্ঠান হতে দেখা যায়। তাই গণতন্ত্র দেশে দেশে কোথাও সংকোচিত আবার কোথাও উদার নৈতিকভাবে ঘোরাফেরা করে। কোথাও কোথাও নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধাভোগী হয় তখন ঘরের শত্রম্ন বিভীষণ হয়ে দাঁড়ায় ভয়ংকর। রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকমতো কাজ করে না। নির্বাহী বিভাগগুলো স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে ক্ষমতার শীর্ষ দেশকে সহযোগিতা করে থাকে। এটা গণতন্ত্রের নীরব ঘাতক। এখানে আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ভূলুণ্ঠিত। এ সময় জনগণ বিভিন্ন দুর্ভোগে দিনাতিপাত করে। এটা গণতন্ত্রের সংকোচন ব্যবস্থা। তাই দেশে দেশে এই গণতন্ত্রের নতুন নতুন শরীরী কাঠামো দেখা যায় পর্দার আড়ালে। শাসক, স্বৈরশাসক কাঠামোয়। একটা কথা আছে 'উপরে ফিটফাট ভিতরে সদর ঘাট।' এটা গণতন্ত্রের পঁচনশীল বীজ বিপণন পদ্ধতি। ছত্রাক শরীরের সারা অঙ্গে বাসা বাঁধে। এগুলোর ভিত খুবই শক্তপোক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হয় এক সময়। খেসারত দিতে হয় জনজীবনের রক্তক্ষয়ে। যেমন- শ্রীলংকার অবস্থা কিছুদিন আগেও এই ভূতে পেয়েছিল। এটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না বলে গণতন্ত্রের আড়ালে বা খোলসে স্বৈরতন্ত্রের কাঠামোয় দেশ চালানো। এ অবস্থা যেসব দেশে চলে তাদের দুর্ভাগা দেশ বলা হয় নিঃসন্দেহে। বহুদিন পুষ্টিহীন থাকার পর যদি কোনো একদিন সুদিন ফেরে তখন তারা উচ্ছল হয়। এটাকে একই অঙ্গে এত রূপ বলা যায়।
গণতন্ত্র আছে তবে তা কারাগারের প্রকোষ্ঠে বন্দি লোকচক্ষুর আড়ালে। এর ফলে, দেশে শ্রেণিবৈষম্য বাড়ে। বেপরোয়া হয় নির্বাহী বিভাগগুলো। রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকমতো কাজ করে না। লুটেরাশ্রেণি তৈরি হয় দেশে। লুট, লুট, হরিলুট। লুটের মাল দরিয়ামে ঢাল অবস্থা হয় ওইসব দেশে। অপুষ্টি, কুশিক্ষা, চোরাগলি পথগুলোয় সবাই হাঁটে আলোকিত রাজপথের পরিবর্তে।
এইতো সেদিন ব্রিটেনে ভোট হয়ে গেল। কনজারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে লেবার পার্টি দীর্ঘ চৌদ্দ বছর অপেক্ষার পর ক্ষমতায় আসে। নেতা পার্টি প্রধান কিয়ার স্টারমার। তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তারা পান ৪১২ আসন। অপরদিকে, কনজারভেটিভ পার্টি বা ঋষি সুনাকের দল পান ১২১ আসন। হয়তো ঋষি সুনাক ভোটারদের প্রতিশ্রম্নতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন, তাই জনগণ তাকে চান নাই। ভোট হয়ে গেল। ফল ঘোষণা হয়ে গেল নির্ধারিত সময়ে। কোথাও কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা নেই। সুশৃঙ্খলভাবে ভোট হলো। পরাজিত কনজারভেটিভ পার্টি ফল মেনে নিয়ে লেবার পার্টির বিজিত প্রধানমন্ত্রী স্টারমারকে অভিনন্দন জানালেন। এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয়। এজন্যই বোধহয় ব্রিটেনকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়ে থাকে।
বিমলেন্দু রায় : কবি ও প্রাবন্ধিক, সাবেক উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক