বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

অতি দর্পে হত লঙ্কা

জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা তাদের শাসনামলের স্বাদ কম-বেশি দেশবাসী ভোগ করেছে। দেশের রাজনীতি নিয়ে নতুন প্রজন্ম এবার চিন্তাভাবনা করবে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টাও করতে পারে। জনগণকে তারা সঙ্গে পাবে।
নূরুর রহমান খান
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অতি দর্পে হত লঙ্কা

(গতকালের পর)

পূর্ববর্তী সব সরকার এবং তাদের কর্ণধারদের চরিত্র ও মুখোশ উন্মোচনের জন্য নিরপেক্ষ ও নির্মোহ, পর্যালোচনা প্রয়োজন যাতে ভবিষ্যতে তাদের পুনার্বিভাবের ফলে দেশবাসীর জীবন ও প্রাণ বিপন্ন না হতে পারে।

ছাত্র-যুবকরা আন্দোলন করেছে ইনসাফের দাবিতে। পরে তাদের সমর্থনে দেশবাসী এগিয়ে আসে। অরাজক অবস্থা থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য কোটাবিরোধীদের আগ্রহ ও অনুরোধে দেশবরেণ্য ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং একটি ক্রান্তিকালে দেশের হাল ধরেন। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং এজন্য সময়ের প্রয়োজন। জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা-হাসিনার স্তূপীকৃত পুরী সাফ-সুতরো করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মূল লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে। এ দুরূহ কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নূ্যনপক্ষে দু'বছর প্রয়োজন। তারপর নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ ইত্যাদির পর নির্বাচনের জন্য আরও অন্তত দু'বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ মোট চার বছর ক্ষমতায় থেকে একটি সুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা চাই একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ।

ইতোমধ্যে একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী শকুন আকাশে ডানা মেলেছে, শ্বাপদগুলো নখ-দন্ত বিস্তার করে বিবর থেকে বেরিয়ে এখনই নির্বাচনের জন্য হাঁকডাক শুরু করেছে। ভাবটা যেন কোটাবিরোধীরা তাদের ক্ষমতায় বসানোর জন্যই আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে। শেখ হাসিনা পালানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু অর্বাচীনের গণভবন, বঙ্গভবনে লুটপাটের দুর্ঘটনা তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন, খুনীদের বিদেশি দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিষ্ঠা, এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী রশিদকে জাতীয় সংসদে নিয়ে আসা ইত্যাদি দেখে তাদের মনে আবার চাঁদ-তারা মার্কা পাকসার জমিনের সুদিনে প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা জেগেছে। তারা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। তার ভাস্কর্য বিনষ্ট করে পৈশাচিক নৃত্যে মেতে উঠেছিল। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও পাঠাগার ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এদের হাল কী হবে সেটা তাদের কল্পনারও অতীত। আমরা সগর্বে দেখেছি পুলিশের অবর্তমানে আমাদের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে কীভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য পরিষ্কার এবং নোংরা দেওয়ালগুলো রং তুলিতে বিজয়গাথা ফুটিয়ে তুলেছে। এরাই আমাদের বর্তমান, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের আস্থা-ভরসা, ভবিষ্যতের নেতা-নেত্রী। আলোকবর্তিকাস্বরূপ এরাই আমাদের পথের দিশারী। শহীদ আবু সাঈদরা মৃতু্যঞ্জয়ী, রক্তবীজের দল। আবু সাঈদের রক্তে উর্বরা জমিতে লক্ষ আবু সাঈদ জন্ম নেবে- এরাই হবে জাতির নিশানদার, পতাকাবাহী।

পরবর্তী নির্বাচনের পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ও করণীয়

১. দ্রব্যমূল্য তথা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বপ্রকার সিন্ডিকেটের মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়া- যাতে কোনোকালে এরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। ডিম থেকে মাছ, মাংস, সবজি- সবকিছু নাকি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে! এখনো তারা সক্রিয়।

২. বাস-মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন এবং সর্বোপরি পুলিশের নাম রয়েছে চাঁদাবাজদের তালিকার শীর্ষে। সর্বগ্রাসী চাঁদাবাজির কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

৩. জুলাই-আগস্টের গণহত্যা থেকে সব হত্যার বিচার এবং রায় দ্রম্নত কার্যকর করতে হবে। নারায়ণগঞ্জের বহু আলোচিত ত্বকী হত্যা মামলার প্রধান আসামি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। নারায়ণগঞ্জের রোমহর্ষক সাত হত্যা মামলার মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত এগারো আসামির রায় এখনো কার্যকর না হওয়ার কারণ প্রধান আসামি একজন প্রাক্তন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্যের জামায়াত এবং সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বা চাকরিচু্যত লে. কর্নেল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক আহত হন। এ হামলায় অভিযুক্তদের রায় যাতে যথাযথভাবে কার্যকর হয় সেদিকেও তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখতে হবে। এক যাত্রায় যেন দু'রকম ফল না হয়।

৪. পুলিশের অপতৎপরতা যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য কলঙ্কজনক না হয়। এরা সেই পুরনো পুলিশ। বেনজির-হারুনের চিন্তাধারা এদের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে বর্তমান। প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য যে কোনো জনকে ফাঁসাতে, গুম কিংবা খুন করতে এদের বিবেকে বাধে না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে, তারা আমাদের শ্রদ্ধেয়, নমস্য। যারা ২০২২-২৩ থেকে প্রবাসী তাদের নামও আছে ২৪-এর জুলাই-আগস্টের হত্যাকারীদের তালিকায়। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে দেখে চিড়িয়া ভাগ গিয়া। ব্যারিস্টার সাহেব সম্ভবত বিপদের আঁচ পেয়ে বছর দুয়েক আগেই তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বিনা পাসপোর্টে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং তার পরিবারের সদস্যরা প্রবাসী। ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমন এক সময় যুবলীগে ছিলেন। তাদের সভায় সরকারি কর্মকর্তা হয়েও থানার ওসি বক্তৃতা করলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন। এজন্য যুবলীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। '২৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রতিমন্ত্রীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। নির্বাচনের আগে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজকর্মের ফলে সুমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সংসদে মন্ত্রী ও দুর্নীতিবাজ সাংসদদের মুখোশ উন্মোচন করে সুমন তাদের রোষানলে পড়েন। ব্যারিস্টার সুমন সংসদে যথার্থ অর্থেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তিনি সর্বদা হাসিনার স্তূতি গাইতেন। কারণ আমাদের মতো তার চোখেও ঠুলি পরানো ছিল। তিনি ভাবতেই পারেননি শেখ হাসিনা দেশের কত বড় সর্বনাশ করেছেন। এজন্য তাকে খুনের আসামি করা যায় না। ডা. সামন্তলালও খুনের আসামি। কারণ আওয়ামী লীগ তাকে মন্ত্রী করেছিল।

৫. বিদেশে পাচারকৃত সমস্ত অর্থ যতদ্রম্নত সম্ভব ফেরত আনতে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে জাতিসংঘের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।

৬. বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অসম ও অসম্মানজনক চুক্তি বাতিল করতে হবে।

৭. বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী দেশ চীন ও জাপানের কাছ থেকে নূ্যনতম হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে তাদের সহযোগিতায় 'তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন চুক্তি' করে দেশের একটি অংশকে বাঁচাতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে প্রকল্পটি সমাপ্ত না হলেও এর শুভসূচনার কৃতিত্ব এ সরকার অর্জন করতে পারে।

৮. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের দায়িত্ব গ্রহণকালীন সময়ে সঞ্চিত ও অর্জিত সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। তাদের মেয়াদ পূর্তির পর দায়িত্ব বা ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ও তাদের সম্পদ ও সঞ্চিত অর্থের বিবরণ দাখিল করতে হবে।

৯. জাতীয় সংসদে নিজ দলের অপকর্মের প্রতিবাদ বা দ্বিমত পোষণকারীকে দল থেকে বহিষ্কার করতেও তার সংসদ-সদস্য পদ বহাল থাকবে এবং তিনি স্বতন্ত্র সাংসদ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

১০. তিরিশ-চলিস্নশ বছর পূর্বে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের উপযোগিতা থাকলেও এখন আর তা নেই। শিক্ষা-দীক্ষায়-সর্বক্ষেত্রে নারীরা বর্তমানে পুরুষের সমকক্ষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য পুরুষের চেয়ে বেশি। নারীদের প্রত্যেক ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হতে হবে। জাতীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রত্যেক দল থেকে ১০% মহিলাকে মনোনয়ন দান বাধ্যতামূলক করতে হবে।

১১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের নবনিযুক্ত উপাচার্যের শিক্ষাগত অর্জন অসাধারণ। আশা করি, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও তিনি সফল হবেন। নির্বাচিত ডিনদের অপসারণ অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদের দলীয় ব্যক্তি বলে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। শূন্য পদগুলোর বিপরীতে নতুন নিয়োগদান তাৎক্ষণিক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বিঘ্নিত হতো না। এখন যাদের নাম শোনা যাচ্ছে কিংবা যারা শূন্য পদসমূহে নিয়োগ লাভের উমেদার তারা তো বিএনপি-জামায়াত ঘরানার খেদমতগার। এদের নিয়োগদান তো নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢালার নামান্তর। তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতার আনুখালস্নাটা অনাবৃত হয়ে যাবে না তো?

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যার স্মরণে ছুটির দিন বাতিল এবং বিভিন্ন অফিস-আদালত থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণের মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। বাঙালির দুর্ভাগ্য এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে। '৭১-এর রূপকথার রাজকুমার বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ছিলেন হানাদার পাক-বাহিনীর কাছে আতঙ্কের প্রতিরূপ আর 'জয় বাংলা' রণধ্বনিতে তাদের হৃদকম্প শুরু হতো। কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমকে পর্যন্ত ১৫ আগস্টে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ৩২নং বাড়িতে যাওয়ার সময় বাধা দেওয়া হয় এবং তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। ফুল দিতে গিয়ে অনেকে লাঞ্ছিত হয়েছেন।

বহু ভাগ্যগুণে বহুপুণ্যের ফলে বাঙালি ঊনবিংশ ও বিংশ- এই দুই শতাব্দীতে চারজনমাত্র বাঙালিকে পেয়েছিল, যারা দেশ-বিদেশে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, সমাজ-সংস্কার- সর্বশেষ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বদরবারে বাঙালিকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাত্র একজন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষা-সাহিত্য, সমাজ সংস্কার তথা কূপমন্ডুকতার গন্ডি থেকে বাঙালিকে মুক্ত করার অগ্রসৈনিক ছিলেন, ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীকে ধারণ করে আছেন স্বয়ং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা ছাড়াও সমাজসংস্কার ও মানবতার প্রচারে যিনি তুলনাবিহীন। বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাসিত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- উভয়েই অসাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতা চেতনার মূর্তপ্রতীক। নেতাজী মাতৃভূমিকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার উদ্দেশ্যে জাপানে গিয়ে আযাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ বিদেশি শাসনমুক্ত করে অবিভক্ত ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে তার বাহিনী নিয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। দেশ বিভক্তির পর তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব উপলব্ধি করেছিলেন শ্বেতাঙ্গরা চলে গেলেও বাঙালি আরেক গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়েছে। তার এই চেতনা রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হতে থাকে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবির অন্তরালে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। তারই চূড়ান্ত ফল '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। যেভাবে স্বাধীনতাকামী মানুষ সুভাষ বসুকে বরণ করেছিল 'নেতাজী' হিসেবে, অনুরূপভাবে বাঙালিও শেখ মুজিবকে হৃদয়ে ধারণ করল 'বঙ্গবন্ধু'রূপে। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তিনি হয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি- জাতির জনক। তার ছবি রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, স্পিকারের কার্যালয়সহ সব গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালতে রাখতে হবে। তার নিচে ডানে রাষ্ট্রপতি ও বামে সরকার প্রধানের ছবি থাকতে পারে। সরকার বদল কিংবা ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও সরকার প্রধানের ছবিরও পরিবর্তন হবে। কিন্তু জাতির জনকের ছবি সব সময়ই একই স্থানে থাকবে। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানরূপে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সবার প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। আজ তার নাম অনেকেই ভুলে গেছেন। ডক্টর ইউনূস ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তাকে হয়তো আমরা পাঁচ-সাত, সর্বোচ্চ দশ বছর মনে রাখলেও রাখতে পারি। কিন্তু যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাঙালির হৃদয়-মনজুড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাদের হৃদয়ে বিরাজ করবেন।

হাসিনা-রেহানা-জয় এবং তাদের কুকর্মের সহযোগী অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ কেউ আত্মগোপনে রয়েছেন। আপাতত প্রাণ বাঁচালেও ভবিষ্যতে তাদের পরিণাম কী হবে তা' একমাত্র আলেমুল গায়েবই জানেন। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের পাপ তো বঙ্গবন্ধুর ওপর বর্তায় না। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ কি এক? বঙ্গবন্ধু আপ্রাণ প্রচেষ্টায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়েছিলেন। তার পেছনে ছিলেন কর্মবীর তাজউদ্দীন আহমদ। ঘরের শত্রম্ন বিভীষণরা তা নস্যাৎ করেছিল ১৯৭৫ সালে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী নিবেদিতপ্রাণ অনেক নেতা তাদের সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং আপসহীন মনোভাবের জন্য অপমানিত হয়ে শেষপর্যন্ত দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী, ড. আবু সাইয়িদ, সোহেল তাজ প্রমুখ। তারা যদি মূলধারার আওয়ামী লীগের হাল ধরেন তাহলে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি হিসেবে হাসিনা-রেহানা-জয় বিবর্জিত আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শ্মশ্রূমন্ডিত এক ভদ্রলোক আচমকা আমাকে প্রশ্ন করলেন, 'আপনি বাঙালি না মুসলমান?' পঞ্চান্ন বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৬৯-এ কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া কলেজে যোগদানের পর বিজ্ঞান বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপিকা প্রথম পরিচয়েই জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আপনি মুসলমান, পাকিস্তানি না বাঙালি?' তার প্রশ্নে বিরক্ত হলেও বলেছিলাম, 'আমি প্রথমে বাঙালি, তারপর মুসলমান এবং শেষে পাকিস্তানি'। পাকিস্তান আমলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের মুখোমুখি অনেকবার হয়েছি। স্বাধীনতার পর আবার নতুন করে এ রকম অবান্তর প্রশ্ন শুনতে হলো। ধর্মের লেবাসধারী স্বাধীনতা-পূর্ব প্রেতাত্মারা কি আবার চোখ মেলে তাকাচ্ছে? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শাসন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো পুরোদ্যমে কাজ শুরু করতে পারেনি, শহীদদের রক্ত শুকোয়নি, সর্বহারা পরিবারগুলোর কান্নার রোল থামেনি- এরই মধ্যে কোনো কোনো দল নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবি করছে। ভাব অনেকটা এই রকম যে তাদের ক্ষমতায় বসানোর জন্যই বৈষম্যবিরোধীরা আন্দোলন করেছে। স্বৈরাচারিণীকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে। ১৬ বছর আওয়ামী লীগ খেয়েছে। এখন আমাদের ভোজনের পালা। উতলা হবেন না। সবুর করুন এবং নিজ নিজ বগলের গন্ধটা শুঁকে দেখুন। এসব দলের অতীত বিচার-বিশ্লেষণ করে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। বিগত পঁচিশ-তিরিশ বছরের স্তূপীকৃত আবর্জনা দূর করে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। অবশ্য সর্বোচ্চ চার বছরের মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে দায়িত্ব ও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা তাদের শাসনামলের স্বাদ কম-বেশি দেশবাসী ভোগ করেছে। দেশের রাজনীতি নিয়ে নতুন প্রজন্ম এবার চিন্তাভাবনা করবে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টাও করতে পারে। জনগণকে তারা সঙ্গে পাবে।

\হজুলাই-আগস্টের রক্তগঙ্গা কিংবা ২১ আগস্টের পৈশাচিক গ্রেনেড হামলার পুনরাবৃত্তি যেমন কাম্য নয়, তেমনি রাজনৈতিক দলে পরিবারতন্ত্র অনাকাঙ্ক্ষিত। একাত্তরের স্বাধীনতা-বিরোধী ঘাতক ও তাদের সহযোগীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের অপচেষ্টাও প্রতিহত করতে হবে।

এ প্রজন্মের তরুণরাই আমাদের ভরসা। তারাই হবেন নতুন যুগের নকিব, জাতির পথপ্রদর্শক। সত্যের জয়, মানবতার জয়, তারুণ্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। মাভৈঃ। ভয় নেই। চরৈবেতি, চরৈবেতি- এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। (শেষ)

ড. নূরুর রহমান খান : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে