একটি বিপস্নবের সাফল্য নির্ভর করে বিপস্নবী সৈনিকদের অদম্য সাহসিকতা ও দৃঢ়তার ওপর। সফল বিপস্নবের জন্য যেমন প্রয়োজন নির্ভীক হৃদয়ের মানুষ, তেমনি প্রয়োজন এমন একটি সর্বজনীন দাবি- যা আন্দোলনের প্রতিটি সদস্যের আত্মার সঙ্গে মিশে থাকবে। কোনো একক ব্যক্তির নেতৃত্বে বিপস্নবের সফলতা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন, কারণ মানুষ কখনোই ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। বিপস্নবী সৈনিকরা যখন তার নেতার ভুলত্রম্নটির বিষয়ে আগে থেকেই অবগত থাকবে তখন তাদের বিপস্নবী উচ্ছ্বাস ও নিষ্ঠায় ফাটল ধরে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসতে পারে জুলাই বিপস্নবের নেতৃত্ব কারা দিয়েছে? এই বিপস্নবের নেতৃত্ব কোনো একক ব্যক্তির হাতে ছিল না; বরং এটি ছিল এক প্রজন্মের সংগ্রামের ফসল। জুলাই বিপস্নবের মূল চালিকাশক্তি ছিল সেই প্রজন্ম, যাদের রক্তে বয়ে যায় ১৯৯৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া তরুণদের স্বপ্ন। এই প্রজন্ম, যারা পরিচিত ডিজিটাল নেটিভস বা 'জেন জি' নামে, তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠরা আজ ২৮ বছরের কুঁড়িতে দাঁড়িয়ে। এই প্রজন্মের সঙ্গেই মিশে ছিল মিলেনিয়ালদের কিছু কনিষ্ঠ সদস্য, যারা তাদের রক্তে ধারণ করেছে বুনো আগুনের শিখা। স্পষ্টতই, ডিজিটাল নেটিভদের জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং মিলেনিয়ালদের কনিষ্ঠ সদস্যরাই জুলাই বিপস্নবের মূল নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল।
ছাত্ররা এই বিপস্নবের সূচনা করে এবং তারা তাদের দাবি সর্বজনীন করতে সক্ষম হয়। ছাত্রদের আকর্ষণীয় কর্মসূচি, হৃদয়গ্রাহী স্স্নোগান এবং সরল উপস্থাপনা সাধারণ জনগণকে সহজেই আকৃষ্ট করে। এর ফলে, দেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে এই আন্দোলন গভীরভাবে স্থান করে নেয়, এমনকি প্রবাসে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধারাও তাদের সমর্থনে রাস্তায় নামেন। উলেস্নখযোগ্যভাবে, রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দুবাইতে রাস্তায় নেমে জুলাই বিপস্নবকে সমর্থন জানাতে গিয়ে জেল এবং জরিমানার সম্মুখীন হন, তবুও তারা ঘরে বসে থাকেননি। ফলে, জুলাইয়ের ছাত্র বিপস্নব রূপ নেয় এক মহান ছাত্রজনতার আন্দোলনে- যেখানে সব বঞ্চিত হৃদয়ের স্পন্দন একসঙ্গে হয়ে ওঠে। ছত্রিশ দিনের এই সংগ্রামে, বিপস্নবীরা চব্বিশে জুলাই মাসকে এক নতুন মাত্রায় অভিহিত করেছে- এক ছত্রিশ দিনের মহাকাব্যিক মাস হিসেবে। কিন্তু এই বিপস্নবের মূল পটভূমি রচিত হয়েছিল অনেক আগে, ২০১৩ ও ২০১৮-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন, ২০১৫-এর ভ্যাটবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ২০১৮-এর নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন মিলে এক মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। সেই চারটি সংগ্রামের সুরেই রচিত হয় চব্বিশে জুলাই বিপস্নবের মহাকাব্য।
২০১৩ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনটির সব সদস্যরাই ছিল মিলেনিয়ালস প্রজন্মের, কারণ এই সময়ে ল্যাচকি জেনারেশন (জেনারেশন জেট)-এর কনিষ্ঠ সদস্যের বয়স তখন ৩৩ বছর আর জেন জির জ্যেষ্ঠ সদস্যের বয়স ১৭ বছর। যেহেতু বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩০ বছর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীর বয়স থাকে সাধারণত ১৮ বছর, সেহেতু ২০১৩-এর কোটা আন্দোলনটি সম্পূর্ণই মিলেনিয়ালদের আন্দোলন হওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। ২০১৩ সালের বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল সরকারি চাকরি সংক্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে একটি উলেস্নখযোগ্য প্রতিবাদ। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচটি বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, 'কোটা'-এর ভিত্তিতে অধিকাংশ নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। 'কোটা'-এর কারণে অনেক পদ শূন্য থাকছে, যেমন ৩২তম বিশেষ বিসিএসের উদাহরণ যেখানে কোটা পূরণে ব্যর্থতার কারণে পিএসসি এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখার বাধ্যবাধকতায় ছিল। ১৩ জুলাই ২০১৩ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত 'মেধা নয়, কোটার প্রাধান্য' শিরোনামের প্রতিবেদনে মেধার অবমূল্যায়নের চিত্র পরিসংখ্যানের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি উলেস্নখ করে যে, গত আট বছরে সর্বমোট তিন হাজার ১৭৯ জন প্রার্থীকে ১৫টি সাধারণ ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল পিএসসি। এর মধ্যে মেধায় এক হাজার ৪৯৩ জন; কোটা থেকে এক হাজার ৬৮৬ জন। এভাবে কোটাপদ্ধতির কারণে মেধাবী ছাত্রদের প্রতিভা বিকাশের দরজাটার আকৃতি ছোট হয়ে এসেছিল- যা খুবই হতাশাজনক। ২০১৩ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য মিলেনিয়ালরা 'মেধা মূল্যায়ন মঞ্চ' নামে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুর রহিম এই কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং শহরের শাহবাগ এলাকায় ১১ জুলাই (বৃহস্পতিবার) শিক্ষার্থীরা অবরোধ করলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ চলে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা চারুকলা অনুষদ থেকে বড় আকারের কয়েকটি ভাস্কর্য নিয়ে এসে সেগুলো রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করে। সংঘটিত সহিংস ঘটনার পর অজ্ঞাত ২,২০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করে শাহবাগ থানার পুলিশ। এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ক্যাম্পাসে ভাঙচুরের অভিযোগে ৫০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। ১৮ জুলাই, ২০১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, 'যারা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বিরোধী ভাঙচুর করেছে, তাদের ভবিষ্যতে কোনো সরকারি চাকরি না পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করবে সরকার।' রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রদত্ত এই তির্যক মন্তব্য মিলেনিয়ালদের একটি ন্যায্য আন্দোলনের পরিসমাপ্তি টানতে বাধ্য করে। তবে, এই আন্দোলন শুধু নিজের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও, এটি দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যায্যতার দাবিতে নতুন এক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছে।
\হপরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ভ্যাটবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে- যা প্রধানত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। এই বিক্ষোভে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলেনিয়াল শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি জেন জির কিছু জ্যেষ্ঠ সদস্যও যুক্ত হন। ২০১০ সালে, সরকার বেসরকারি উচ্চশিক্ষার ওপর পরোক্ষ মূসক আরোপের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের কারণে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। পাঁচ বছর পর, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার ওপর ৭.৫ শতাংশ মূসক আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৩৪টি সরকারি এবং ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, পাশাপাশি ৬৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজও বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪,৫০,০০০ ছাত্রছাত্রী শিক্ষা গ্রহণ করছেন। যদিও এগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ, তবুও এখানে অনেক মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান অধ্যয়ন করছে, যাদের বেশিরভাগই প্রাইভেট টিউশন বা খন্ডকালীন কাজের মাধ্যমে পড়াশোনার খরচ বহন করে। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত মূসক আরোপের চেষ্টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সামর্থ্য সংকুচিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যেই আর্থিক চাপের মুখোমুখি, এই প্রস্তাবিত মূসক তাদের ওপর চূড়ান্তভাবে আরোপিত হলে সেই চাপ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ফলে, ২২ জুন বেসরকারি শিক্ষা অধিকার আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্ররা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন করে এবং পরবর্তী সময়ে একটি মিছিল বের করে। ওইদিন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে এবং মূসক প্রত্যাহারের লক্ষ্যে একটি মিছিল সহকারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। তবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তারিখে যখন ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা মূসকবিরোধী একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের কঠোর বাধার মুখে পড়ে। পুলিশ ফাঁকাগুলি ছোড়ে, যার ফলে, প্রায় ২৩ জন শিক্ষার্থী আহত হন। ১০ সেপ্টেম্বর যখন ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন ছাত্রলীগের আক্রমণাত্মক ভূমিকা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার চলতি অর্থবছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর আরোপিত সাড়ে সাত শতাংশ মূসক প্রত্যাহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তটি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। ২০১৫-এ বাংলাদেশে ভ্যাটবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ প্রমাণ করেছে, যে কোনো অন্যায় চাপিয়ে দিলে ছাত্রসমাজই প্রথমে প্রতিবাদ করে এবং তাদের সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলন শুধু শিক্ষার ওপর আরোপিত ভ্যাটের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং তা ছিল শিক্ষা, সমতা এবং সামাজিক ন্যায়ের জন্য এক সংগ্রামী প্রতীক।
২০১৩ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনটি সফল না হওয়ায় ছাত্রদের মাঝে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। পাঁচ বছর পর, এই ক্ষোভ নতুনভাবে উন্মোচিত হয়ে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে পরিণত হয়। ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরির সামনে 'বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ' গঠন করা হয় কোটার সংস্কারের দাবিতে। এই সংগঠনের ব্যানারে সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলনে মিলেনিয়ালস এবং জেন জির প্রায় সমানসংখ্যক সদস্য অংশগ্রহণ করেছিলেন। যখন এই দুই প্রজন্মের ছাত্ররা তাদের পাঁচ দফা দাবি নিয়ে সামনে আসে, তখন তাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় একটি ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। তাদের অন্যতম দাবি ছিল কোটায় নিয়োগের হার ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে কমিয়ে আনা। এই দাবিগুলি কেবলমাত্র লেখনীতে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব আন্দোলনে পরিণত হয় ৮, ৯, ও ১০ এপ্রিল। এই দিনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ হাজার হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে এবং সরকারকে কোটা সংস্কারের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। অবশেষে, ১১ এপ্রিল, জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কারের পরিবর্তে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করার ঘোষণা দেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন ছিল 'নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন,' যা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করে। ফলে, এই আন্দোলনে জেন জিরের সদস্যদের সংখ্যা মিলেনিয়ালদের তুলনায় বেশি ছিল। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন একটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সড়ক বিক্ষোভের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে গভীর প্রভাব ফেলে।
এই চারটি ছাত্র বিপস্নব যেন একেকটি নদীর স্রোত- যার প্রতিটি তরঙ্গ পরবর্তী তরঙ্গে প্রবাহিত হয়। এসব আন্দোলনের মূলে ছিল একটাই লক্ষ্য রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রতিটি বিপস্নবের প্রভাব ছিল পরবর্তী আন্দোলনে স্পষ্ট, মিলিতভাবে সৃষ্টি করেছিল জুলাই বিপস্নবের ঐতিহাসিক ধ্বনি। যদিও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রজন্ম এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল, প্রতিটি আন্দোলনের প্রতিপক্ষ ছিল রাষ্ট্র। প্রতিটি বিপস্নবে রাষ্ট্রের কর্তা ছিলেন একজনই, যিনি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে অবস্থান করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন। ফলে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার পরেও, গত দেড় যুগ ধরে একটি স্বেচ্ছাচারী সরকারের হাতেই রাষ্ট্রের শাসন ছিল। তাছাড়াও রাষ্ট্রের প্রধান কর্তা ব্যক্তিরা ছিলেন বেবি বুমারস প্রজন্মের, জেন জিরের হৃদয়ের স্পন্দন ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং, তারা এই নতুন প্রজন্মকে 'টিকটক প্রজন্ম' বলে অবজ্ঞা করেছেন- যা সরকারের বিচক্ষণতার অভাবের দিকনির্দেশক। মামলা, হামলা এবং প্রায় সাত শতাধিক ছাত্রের প্রাণহানি এসব নির্মমতার দ্বারা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করা হয়। অবশেষে, জুলাইয়ের ছাত্র বিপস্নব এক বিশাল অভু্যত্থানের রূপ নেয়। ৫ আগস্ট, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার সিংহাসন ত্যাগ করে দেশকে অন্ধকার ভবিষ্যতের মধ্যে রেখে দ্রম্নত দেশত্যাগ করেন। ৮ আগস্ট, জেন জিরা ক্ষমতাভার গ্রহণ করেন, এখন তারা রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন।
জুলাইয়ের ছাত্র বিপস্নব শুধু একটি প্রজন্মের বিজয় নয়, বরং এটি ছিল রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সব বঞ্চিত ও শোষিত হৃদয়ের মিলিত প্রতিরোধ।
জেন জি প্রজন্মের নেতৃত্বে এই বিপস্নব শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে- যেখানে তরুণরা তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য নির্ভীকভাবে লড়াই করতে প্রস্তুত। স্বপ্নের বীজ বুনেছে সেই প্রজন্ম- যারা পুরনো সব অবিচার ভেঙে নতুন দিনের আলোয় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ইতিহাসের এই অধ্যায় সাক্ষী হয়ে থাকবে, যে তরুণদের হাতে গড়ে উঠেছে একটি নতুন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ২.০।
ড. ইলিয়াছ প্রামানিক : সহযোগী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর