একটা প্রবল ভূমিকম্প- প্রচন্ড ঝাঁকুনি দেওয়ার পরপরই যেন সুনামির তান্ডবে বাংলাদেশ ক্ষত-বিক্ষত, বিধ্বস্ত। বাতাসে লাশের গন্ধ। পথে-ঘাটে রক্তের ছোপ, সন্তান-স্বজনহারাদের আহাজারি। সর্বত্র অনেকটা যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থার মতো চিত্রে রক্তরঞ্জিত শেখ হাসিনার মুখাবয়ব। কোথায় ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, কামরুল ইসলাম, সালমান এফ রহমান? কোন গহ্বরে ঢুকেছে ছাত্রলীগের ষন্ডা আর যুবলীগের পান্ডারা? ডিবির কুখ্যাত হারুন ধরা পড়লেও তার বাহিনীর চিহ্নিত স্যাঙাৎরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনতিবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ হত্যাকান্ডের জন্য রংপুরের পুলিশ কমিশনারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মামুলি প্রত্যাহারের আবরণে দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশদের রক্ষা করা হচ্ছে। পুলিশকে সব সরকারই দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের ফলে এরা সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে চিহ্নিত। বিপদে পড়লেও সাধারণ মানুষ থানা-পুলিশ এড়িয়ে চলে।
সেনাপ্রধানের বিচক্ষণতায় এবং জনগণের ইচ্ছা ও সমর্থনে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। দেশে সামরিক শাসন নেই এবং তা কোনোক্রমেই কোনো সভ্য দেশ ও জাতির প্রত্যাশিতও নয়। দেশের অরাজক পরিবেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও এটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। কাজেই সরকারকে চার-পাঁচ মাসের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন এবং সে অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর দেশ স্বাভাবিক পথে চলেনি। পরিস্থিতি জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় এনেছিল। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যই স্মৃতিচারণ আবশ্যক।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কাঁধে সওয়ার হয়ে বাংলাদেশের অন্যতম খলনায়ক খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে জেনারেল সফিউলস্নাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেন। এ বছর ৭ নভেম্বর এক অভু্যত্থানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসেন এবং বিচারপতি সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৬-এর ৩০ নভেম্বর জেনারেল জিয়া বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। তারপর ইতিহাসের কূটচক্রে ১৯৭৭-এর এপ্রিল বিচারপতি সায়েম দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন এবং জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত করেন। তার শাসনামলে কর্নেল তাহেরসহ বিভিন্ন সেনানিবাসে সামরিক অভু্যত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে বিনা প্রমাণে ১৭-১৮শ' সৈনিককে ফাঁসি দেওয়া হয়। এ সময়ের বহুল আলোচিত ন্যক্কারজনক ঘটনা '৭৭-এ জাপান এয়ারলাইন্সের বোয়িং হাইজ্যাক করে ঢাকায় নিয়ে আসাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহু উচ্চপদস্থ অফিসারকে ফাঁসি, বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়, অনেককে চাকরিচু্যত করা হয়। তাদের পরিবার-পরিজন এখনো এই হত্যার বিচার দাবি করছেন। ১৯৭৭-এর ৩০ শে ভোটারবিহীন তথাকথিত গণভোটে একক প্রার্থী জিয়ার পক্ষে ৯৮.৮৮% হঁ্যা-সূচক ফলাফল দেখানো হয়। তার বিপরীতে সংরক্ষিত কারও বাক্সে পড়ে ১.১২% ভোট। সুতরাং বিপুল ভোটে নিষ্প্রাণ বাক্সটিকে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে জিয়ার সমর্থনে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুর সাত্তার জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বা জাগদল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এটি ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল' বা বিএনপিতে রূপান্তরিত হয় এবং জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে এ দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও তিনি পূর্বেই ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়ে বুলন্দ কণ্ঠে এলান করেছিলেন যে, রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি হারাম করে দেবেন। এখন নিজেই উর্দি পরিত্যাগ না করে রাজনীতির মাঠে নেমে গেলেন। সুবিধাবাদীরা প্রথম সুযোগেই সরকারি দলে ভিড়তে শুরু করেন। আমার পরিচিত পুরান ঢাকার একজন প্রভাবশালী সর্দার এদের অন্যতম। দেখা হতে জিজ্ঞেস করলাম, 'চাচা, সর্দারি ঠিকাদারি ছাইড়া পলিটিক্সে নাম লেখাইলেন। আপনার লিডারকে কেমন মনে হয়? অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, 'হালায় এক নম্বর পিনিয়ার। বেবাক ময়দান খালি কইরা মর্দে নিজেই গোনে খাড়ায়া গ্যাছে।' কিছুদিন আগে টেলিভিশন টকশোতে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান শুরু করলেন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান' এটুকু শোনার সঙ্গে সঙ্গে চ্যানেল পরিবর্তন করি এবং একটি মনোহারি ঢাকাইয়া চুটকি মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। এক সুবেশি বাবু গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, '...জায়গায় যাবে ভাড়া কত?' গাড়োয়ান যে ভাড়া হাঁকল তা শুনে ক্রুদ্ধ বাবু তার তিনভাগের একভাগ; অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ ভাড়া বললেন। গাড়োয়ান সহাস্যে বলল, 'আস্তে কন কত্তা। আপনের কথা হুনলে ঘোড়ায় বি হাসব।' আফসোস, ঢাকাইয়া ভাষা বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এ ভাষার উইট, হিউমার, জোকও বিলুপ্তপ্রায়। জিয়া তার মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলিম এবং জামায়াতে ইসলামীর ইসহাকের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের অন্তর্ভুক্ত করে সমালোচিত হয়েছিলেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের নলের মুখে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে পাকিস্তান প্রত্যাগত জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ ও দেশে সামরিক আইন জারি করেন এবং বিচারপতি আহসান উদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করা হয়। উচ্চাভিলাষী ক্ষমতালিপ্সু উর্দিপরিহিতদের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী এরশাদও ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি আহসান উদ্দিনকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির গদি দখল করেন। তার ভন্ডামির চরম নিদর্শন, নৈতিকতা শব্দটির বিন্দুমাত্র যার চরিত্রে নেই তিনিই কি-না 'ইসলাম'কে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলেন। ধর্মপ্রাণজন লজ্জা নিবারণার্থে লুঙ্গি পরতে শুরু করলেন। এরপর এরশাদেরও পদক্ষেপ পূর্বসূরি জিয়ার অনুকরণ বা অনুসরণ। ১৯৮৫ সালের ২৯ মার্চ এরশাদ তথাকথিত গণভোটের প্রহসন করে তার অনুকূলে ৯৪.১৪ আস্থা ভোটের বিরাট সাফল্য দেখান। এ ধরনের গণভোটের মাজেজা হলো এতে প্রার্থী যেমন একজন থাকেন, ভোটার উপস্থিতির প্রয়োজন নেই।
১৯৮৩ সালের নভেম্বরে এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে 'জনদল' গঠিত হয়। '৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এ দলের সঙ্গে আরও চারটি নামসর্বস্ব দল যুক্ত হয়ে জাতীয় পার্টির আবির্ভাব এবং এ বছর ২ সেপ্টেম্বর এরশাদ বে-আব্রম্ন হয়ে, অর্থাৎ উর্দি পরিহার করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুর্নীতি-প্রতারণা-শঠতার মধ্য দিয়ে ১৯৮২-র মার্চ থেকে '৯০-এর ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে শেষপর্যন্ত গণ-অভু্যত্থানের মুখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ২৭ নভেম্বর বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) আহূত সারাদেশে ধর্মঘটের সময় এরশাদ বাহিনীর গুলিতে ডা. শামসুল আলম (মিলন) নিহত হলে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে পৌঁছে। তিনি গদিচু্যত হলেন। সেদিনও ঢাকা বিজয় উলস্নাসে মেতে উঠেছিল। শেষ ভরসা সেনাবাহিনীও স্বৈরাচারকে সমর্থন করেনি। ফলে '৯০-এর ৬ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। ১৯৯২ সালের আগস্টে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সন্ত্রাস দমনে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ আনেন। ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত মিরপুর উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে মো. হানিফের কাছে সরকারি দলের প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলে হানিফের দুই সমর্থককে লালবাগে হত্যা করা হয়। ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপনির্বাচনে প্রকাশ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতির ফলে সংসদে বিরোধী দলগুলোর ১৪৭ জন সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। বাধ্য হয়ে ১৯৯৬-এর ফেব্রম্নয়ারিতে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে ভোটারবিহীন সন্ত্রাসের মধ্যে নির্বাচনের প্রহসন হয়। এ প্রহসনে খালেদা জিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফ্রিডম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল রশিদ জাতীয় সংসদকে অপবিত্র করার সুযোগ লাভ করেন। খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৫ সময়সীমার শাসনামলে প্রশাসন দলীয়করণ, তার নিকট আত্মীয়স্বজন, মন্ত্রিসভার সদস্য, দলীয় এমপি ও কর্মকর্তারা দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। ফলে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও মাত্র চারটি আসনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। ফলে জাতীয় পার্টি ও জাসদের (রব) সহযোগিতায় শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভায় ওই দুটি দল থেকে দুজনকে পূর্ণমন্ত্রী করা হয়। এ মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) হাসিনা সরকারের দুটি উলেস্নখযোগ্য ঘটনা হলো 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল' এবং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় 'ইউনেস্কো' ২১ শে ফেব্রম্নয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
৭ম জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হলে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত-বিজেপি-ইসলামী ঐক্যজোট সমবায়ে গঠিত মোর্চা জয়লাভ করে। খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষনেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আল আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে পূর্ণমন্ত্রী করেন। মন্ত্রিপরিষদে চিহ্নিত অপরাধীদের অন্তর্ভুক্তি সাধারণ মানুষ প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেনি। পরে মানবতাবিরোধী কয়েকজনের সঙ্গে এ দু'জনকেও ফাঁসিরকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হয়। খালেদা জিয়া সরকারের এই মেয়াদকালে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। নির্বিচারে গ্রেপ্তার, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের হাতে খুনের শিকার হন খুলনার আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, গাজীপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য আহসানউলস্নাহ মাস্টার, আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়া। তাদের আক্রোশ থেকে নিষ্কৃতি পাননি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও বিশিষ্ট লেখক শাহরিয়ার কবির, ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক সানিম সামাদ, রয়টারের সংবাদদাতা এনামুল হক, এনজিওকর্মী জিজিলা রাজ। একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে পুলিশি অভিযান ও ছাত্রীদের গ্রেপ্তারের মতো জঘন্য ঘটনাও এ সরকারের আমলে ঘটে।
খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম পর্যায়ে (১৯৯১-৯৫) এবং জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬) ইসলামভিত্তিক জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জেএমবি, আনসারুলস্নাহ বাংলা টিম, হরকাত-উল জিহাদ, আলস্নাহর দল ইত্যাদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে এবং জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইদের মতো দুর্ধর্ষ জঙ্গির উত্থান ঘটে। এরা ১৯৯১-তে যশোরে উদীচী সম্মেলন, '৯৯-এ খুলনার আহমদিয়া মসজিদে, ২০০০ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ায় তার জনসভাস্থলে ৭০ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা, ২০০১-এ সিপিবির জনসভায়, রমনার বটমূলে ছায়ানটের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক আহত হন। এ সময় বহুল আলোচিত 'হাওয়া ভবন' থেকে বদলি, নিয়োগ, টেন্ডার, ব্যবসা, কমিশন ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হতো। অনেকে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও নির্দেশ এ অফিস থেকেই হয়েছিল। অফিস-আদালত থেকে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণের মতো অমার্জনীয় পাপকর্ম এ সময়ই হয়েছিল। আরেকটি ঘটনার উলেস্নখ না করলেই নয়। জেনারেল জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তখন তাদের মনোনীত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। জিয়ার মৃতু্যবার্ষিকীতে তার কবরে ফুল দিতে না যাওয়ায় তাকে ২০০২ সালে অপমানজনকভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ডা. চৌধুরীর বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক। জিয়ার মৃতু্যবার্ষিকীতে তার কবরে ফুল দিতে গেলে ডা. চৌধুরীকে অবশ্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মাজারে তার শাহাদাতবার্ষিকীতে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হবে এবং সেটা বিএনপির মনঃপূত হবে না। সুতরাং তিনি কারও কবর জিয়ারতে যাবেন না। তবে বিএনপির ভিত্তি স্থাপনে তার অবদানের কথা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে দলনেতারা তাকে অবাঞ্ছিত বিবেচনায় ছুড়ে ফেলে দিলেন। বিএনপির সুহৃদ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলতে শুরু করেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। খালেদা জিয়া তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েই ক্ষান্ত হননি, ২০১১ সালে প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোলস্না ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী নন। তিনি তাদের মুক্তিও দাবি করেছিলেন। যদি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ না হয়ে থাকে তাহলে জিয়াউর রহমান কোন দেশের কোন অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন? স্বাধীনতা ঘোষণার অন্যতম পাঠক হলেন কীভাবে? 'বীরউত্তম' খেতাবে ভূষিত হবেন কোন সূত্রে?
জোট সরকারের চরম অরাজকতার সুযোগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে (১/১১ নামে খ্যাত) এবং ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিন গং-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু'বছরের শাসনামলও ছিল দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক অধীন ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোটভুক্ত দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-১৪) সরকার গঠন করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়। এ সময়ই পদ্মাসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শেখ হাসিনা সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদ মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে শেষ হলেও সংক্রামক ব্যাধির মতো দুর্নীতি দলীয় নেতা, মন্ত্রী, সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন। প্রকৃতপক্ষে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে নির্বাসনে দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনই ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আরেকটি মারাত্মক অভিযোগ দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের ভোট আগের রাতেই প্রশাসনের সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়েছিল- যা এখন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। এ সময় দুর্নীতির করালগ্রাস ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রধান বিরোধী দল গঠনমূলক কাজের পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক পদ্ধতিতে ও কথার ফানুস উড়িয়ে সরকার পতনের পন্থা অবলম্বন করায় জনগণ তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। বিশেষ করে এদের শাসনকালেও জনজীবনে স্বস্তি ছিল না। এমনি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এ নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হলো দিনের বেলাতেই ভোট হয়েছিল। এবার আমরা অনেকে ভোট দিয়েছি কিন্তু প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করায় এ নির্বাচনও একতরফা হয়েছিল। শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠন করে বেপরোয়া বেসামাল হয়ে উঠলেন। তার স্বৈরাচারী মনোভাবকে চাঙ্গা রাখল কতিপয় অসৎ দলীয় নেতাকর্মী- বিশেষ করে ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সালমান এফ রহমান প্রমুখ এবং হাসিনার আত্মীয়স্বজন- অন্তরালে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন শেখ রেহানা, জয়, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক। সহযোগী ছিলেন ডজনখানেক আমলা। তৈরি হলো লুটেরা গোষ্ঠী। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার ইত্যাদি আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আমরা এমনি মোহাচ্ছন্ন হলাম, এসব উন্নয়নের অন্তরালে দেশ যে কোন অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে তা বোঝারও ফুরসৎ হলো না। প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ থেকে শুরু করে সর্বস্তরে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় সবাই মেতে উঠল। ঘোষিত অনাকাঙ্ক্ষিত প্রত্যয় স্কিমের ফলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হলো। এ আন্দোলন ছিল অধিকার আদায়ের, সরকার পতনের নয় এবং সম্পূর্ণ অহিংস। শেখ হাসিনা খোলা মন নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একবার বসলে সহজে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হতো। কিন্তু তিনি উল্টো পথ ধরলেন। নির্মম দমন-পীড়নের দ্বারা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্রলীগ নামধারী অছাত্র সশস্ত্র বহিরাগতদের লেলিয়ে দিলেন। মার খেয়ে আন্দোলনকারীরা রুখে দাঁড়ালে পুলিশকে ব্যবহার করা হলো ছাত্রলীগের বিকল্প সশস্ত্র ক্যাডার হিসেবে। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড বোমা এবং সর্বশেষ গুলি- এমনকি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে ঢাকাসহ সারাদেশে ছয় শতাধিক শিশু-কিশোর, ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মারা হলো। পঙ্গু হলো প্রায় দু'হাজার। পথে বসেছে সর্বহারা অসংখ্য পরিবার।
শেখ হাসিনা বিস্মৃত হয়েছিলেন কয়েকজনের প্রাণের বিনিময়ে '৫২-৫৩ রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠা। এক ডাক্তার মিলনের হত্যায় স্বৈরাচার এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। স্বৈরাচারিণী হাসিনা সারাদেশে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সেদিন ক্রুদ্ধ জনতার হাতে পড়লে তার হাড়-মাংসের খোঁজও পাওয়া যেত না। একেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ, ধর্মপ্রাণদের ভাষায় আলস্নাহর বিচার।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
ড. নূরুর রহমান খান : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়