শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঈদে মিলাদুন্নবী ইতিহাস, তাৎপর্য ও ফজিলত

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের জন্য একটি মহান উপলক্ষ। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক দিন নয়, বরং এটি নবীজীর (সা.) প্রতি ভালোবাসা, সম্মান এবং তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের একটি সুযোগ।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ঈদে মিলাদুন্নবী ইতিহাস, তাৎপর্য ও ফজিলত

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) হলো ইসলামের শেষ নবী ও রসুল হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন। বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক স্থানে এটি বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করা হয়। হিজরি সালের ১২ রবিউল আউয়াল, প্রিয় নবী (সা.) মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি আশীর্বাদ ও দৃষ্টান্ত। মহান আলস্নাহ তার প্রিয় রসুল (সা.)-কে মানবজাতির জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। কোরআনে বলা হয়েছে, 'আমি তোমাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি।' (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, রসুল (সা.)-এর জন্ম মানবজাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তার মাধ্যমে আলস্নাহ মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করেছেন এবং মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে গেছেন। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে মুসলিমরা নবীজীর সিরাত অধ্যয়ন করে এবং তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার চেষ্টা করে। রসুলের (সা.) জীবন আমাদের জন্য একটি পরিপূর্ণ মডেল। কোরআনে আলস্নাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই, তোমাদের জন্য আলস্নাহর রসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।' (সূরা আহযাব : ২১) এই আয়াত আমাদের নবীজীর (সা.) জীবন অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেয়। তার চারিত্রিক গুণাবলি, ধৈর্য, দয়া, সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং আলস্নাহর প্রতি ভালোবাসা আমাদের প্রতিটি কাজে মডেল হিসেবে কাজ করে। রসুল (সা.) ইসলামের মূল বার্তা প্রচার করেছিলেন- যা হলো একত্ববাদ। তিনি মক্কা ও মদিনায় তাওহীদের (আলস্নাহর একত্ববাদ) প্রচার করেছিলেন। তার জন্ম ছিল সেই বার্তার আরম্ভ- যা মানবজাতির জন্য চিরস্থায়ী কল্যাণ বয়ে এনেছে। তাই তার জন্মদিন পালন করা মূলত সেই বার্তাকে স্মরণ করা এবং প্রচার করা।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করার রেওয়াজ প্রাথমিক ইসলামী যুগে দেখা যায়নি। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা শুরু হয় অনেক পরে। ফাতিমীয় শাসনামলে (৪র্থ/৫ম হিজরি/শতাব্দীতে) মিশরে এই দিনটি প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে উদ্‌যাপিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই দিনটিতে ইসলামী দুনিয়া নবীজীর (সা.) জন্ম ও জীবন সম্পর্কে আলোচনা করে এবং তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষকে আলোকিত করার চেষ্টা করে।

নবীজীর (সা.) জন্ম ও তার জীবনের ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস ও কোরআনের আয়াত রয়েছে। তার জন্ম ও আগমনের মাধ্যমে আলস্নাহ সমগ্র সৃষ্টিকে পথ দেখিয়েছেন। রসুলের (সা.) প্রতি ভালোবাসা ও তার জীবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের জন্য একটি মহৎ উপলক্ষ্য। আলস্নাহ বলেন, 'তোমরা আলস্নাহ ও তার রসুর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাদের সম্মান কর ও শ্রদ্ধা কর।' (সূরা ফাতহ : ৯) নবীজীকে (সা.) ভালোবাসা ও সম্মান করা ইমানের অন্যতম শর্ত। ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের মাধ্যমে আমরা সেই ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। রসুলুলস্নাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে আলস্নাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই, আলস্নাহ এবং তার ফেরেশতারা নবীজীর প্রতি দরুদ পাঠান। হে মুমিনরা, তোমরাও তার প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠাও।' (সূরা আহযাব : ৫৬) এই আয়াতের ভিত্তিতে ঈদে মিলাদুন্নবীতে নবীজীর (সা.) প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি কাজ। এটি আমাদের জন্য রহমত এবং পাপ থেকে মুক্তির একটি উপায় হতে পারে।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আমাদের করণীয়গুলো হলো নবীজীর (সা.) জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা এবং সেই আলোকে নিজেদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা এবং ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। রসুলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করে, আলস্নাহ তার প্রতি ১০ বার রহমত পাঠান।' (মুসলিম শরিফ) এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, দরুদ পাঠের মাধ্যমে আলস্নাহর রহমত লাভ করা যায়। নবীজীর (সা.) জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা এবং তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। তার চারিত্রিক গুণাবলি, ধৈর্য, দয়া, সততা ইত্যাদি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত। ঈদে মিলাদুন্নবীতে নবীজীর (সা.) সীরাত নিয়ে আলোচনা এবং তা চর্চা করা আমাদের অন্যতম করণীয়। ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসার করা উচিত। নবীজীর (সা.) জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তা পরিবার, সমাজ এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। ইসলাম মানবজাতির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা এবং তা প্রচার করা সবার করণীয়। নবীজী (সা.) সব সময় দান-সদকা এবং সমাজের দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করার ওপর জোর দিয়েছেন। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে দরিদ্রদের সাহায্য করা, তাদের প্রয়োজন মেটানো এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করা একটি উত্তম করণীয়।

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের জন্য একটি মহান উপলক্ষ। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক দিন নয়, বরং এটি নবীজীর (সা.) প্রতি ভালোবাসা, সম্মান এবং তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের একটি সুযোগ।

কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমাদের করণীয় হলো নবীজীর (সা.) জীবন অনুসরণ করা, ইসলামের সঠিক পথ অনুসরণ করা এবং আলস্নাহর প্রতি একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করা। নবীজীর (সা.) জন্মদিন পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে পারি, ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজ গঠন করতে পারি- যা পৃথিবীতে শান্তি ও সম্প্রীতি বয়ে আনতে পারে।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে