২০০৭ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা উৎসাহিত করা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সচেতনতা তৈরি করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটির গুরুত্ব বর্তমানে নতুন মাত্রায় এসে পৌঁছেছে, বিশেষত সদ্য ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার গণঅভু্যত্থানের পর যেখানে তারুণ্যের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পুনরায় স্বাধীনতা লাভ করেছে। এই অভু্যত্থান শুধু শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের নয়, এটি একটি গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের সূচনা।
৩৬ জুলাই এবং নতুন গণতন্ত্রের জন্ম : সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে ৩৬ জুলাই তথা পাঁচই আগস্ট তারিখকে। এই দিনে ছাত্র-জনতা এবং তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে এক বিশাল গণঅভু্যত্থান সংঘটিত হয়- যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীনতা ফিরে পায়। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে এই তরুণদের সংগ্রাম এবং তাদের দৃঢ়তা এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়। শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর বাংলাদেশ একটি নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এই অভু্যত্থানের মূলে ছিল তরুণ প্রজন্মের সাহস এবং তাদের নেতৃত্ব। ছাত্রদের নেতৃত্বে তরুণরা এই সংগ্রামে অংশ নিয়ে দেশকে স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের প্রচেষ্টা এবং আত্মত্যাগের ফলস্বরূপ বাংলাদেশ এখন এক নতুন গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। তবে এই নতুন গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন একটি সুদৃঢ় ভিত্তি। এ ভিত্তি গড়ে তুলতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জনসম্পৃক্ততার চর্চা করা জরুরি।
তারুণ্যের অগ্রণী ভূমিকা গণতন্ত্রের জন্য নতুন দিগন্ত : বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বহুদিন ধরেই দেশকে একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। তাদের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং তারা নতুনভাবে গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে এই তরুণদের ভূমিকা অপরিহার্য।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, 'গণতন্ত্র শুধু একটি সরকার ব্যবস্থা নয়, এটি একটি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন শিক্ষার এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা- যা আমাদের প্রতিদিনের জীবন এবং পারিবারিক পরিবেশে প্রতিফলিত হতে হবে।'
নতুন গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ : শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতি ঘটে। বিচার বিভাগ, সংবাদমাধ্যম এবং আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোকে কার্যত তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তার শাসনামলে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য উদাহরণ দেখা যায়। গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ এবং বিরোধীকণ্ঠকে দমন করার চেষ্টা চলতে থাকে।
কিন্তু ৩৬ জুলাইয়ের আন্দোলন এই অবস্থা পাল্টে দেয়। তরুণ প্রজন্মের সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশ নতুন করে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এই পথ কোনো সহজ পথ নয়। নতুন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক পথচলাকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এবং নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হলো ঈঅজঙ (ঈধৎব ভড়ৎ অংংবঃং, জবংড়ঁৎপবং ধহফ ঙনষরমধঃরড়হং)। এই আন্তর্জাতিক নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠানটি তরুণদের নেতৃত্ব বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য একটি আদর্শ উদাহরণ। ঈঅজঙ তরুণদের বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেয়, তাদের কমিউনিটিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করার সুযোগ দেয় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এমন অরাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান আরও বেশি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ ঘটানোর জন্য, যুব ক্ষমতায়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে।
গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করতে তারুণ্যের অগ্রযাত্রা : গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য তরুণদের দায়িত্ব কেবল রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং তাদের দৈনন্দিন জীবনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাগত জীবনে গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। প্রতিটি ব্যক্তির মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে তরুণদের এই নতুন প্রজন্ম কেবল তাদের নিজস্ব উন্নয়ন নয়, বরং পুরো দেশকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে। সঠিক নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এই প্রজন্মকে নতুন যুগের বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম করবে।
গণতন্ত্র এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (অও) চ্যালেঞ্জ : এ বছরের গণতন্ত্র দিবসের প্রতিপাদ্যে সুশাসনের একটি হাতিয়ার হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (অও) ব্যবহার। অও যেমন গণতন্ত্রের চর্চায় সাহায্য করতে পারে, তেমনি এটি অপব্যবহার করে গণতন্ত্রকে দুর্বলও করতে পারে। ডিপফেইক, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং হেট স্পিচের মাধ্যমে অও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষতি করতে পারে। তবে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে অও নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।
গণতন্ত্রের নবযাত্রা : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে, কিন্তু এ যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। ৩৬ জুলাইয়ের গণঅভু্যত্থান বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যেখানে তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন গণতন্ত্র গড়ে উঠছে। তবে এই নতুন গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করতে হলে তরুণ প্রজন্মের সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনা, জনসম্পৃক্ততা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্রের চর্চা ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এভাবে বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে, যেখানে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে।
খালেদ সাইফুলস্নাহ : সমাজকর্মী