ব্রিটিশ তাড়াতে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভূমিকা
ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে যে পরিমাণে লুটতরাজ করেছে তার হিসাব আদায় করার উদ্দেশ্য ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের। তাই নিজেদের রক্ষার্থে ব্রিটিশরা দ্বি-জাতি তত্ত্বের অবতারণা ঘটায় সুকৌশলে এবং ধর্মীয় প্রলেপে উপমহাদেশকে দু'ভাগ করেন।
প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রথমে বাংলা পরে সমগ্র উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতকে দু'টি ভাগে ভাগ করে- একটি পাকিস্তান, অন্যটি ভারত। ভাগ করার বিষয়টি ছিল দ্বি-জাতি তত্ত্ব। এখানে প্রশ্নটা হলো, ব্রিটিশরা কি দ্বি-জাতি তত্ত্বের আন্দোলনকারীদের চাপে পড়ে উপমহাদেশ ছেড়ে পালিয়েছিল, নাকি নিজেদের রক্ষা করার জন্য দ্বি-জাতি তত্ত্বের মোড়কে উপমহাদেশের স্বাধীনতা দেয়। ১৯৪৭ সালের পর পার হয়ে গেছে প্রায় ৭৭ বছর। এখন অনেকেই দাবি করছেন '৪৭-এর দেশ ভাগ দ্বি-জাতি তত্ত্বের আন্দোলনের ফসল। যার মুখ্য ভূমিকায় জিন্নাহ তথা পাকিস্তান। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭- এই দীর্ঘ সময়জুড়ে ব্রিটিশ তাড়ানো আন্দোলন করেছে উপমহাদেশের মানুষ। এ সময়ের আন্দোলনগুলো কোনোটিই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ইসু্যতে হয়নি। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ হওয়াটা কোন আন্দোলনের ফসল, তবে ১৯৪৭-এর দেশভাগটা ছিল ব্রিটিশদের গাত্র জনরোষ থেকে রক্ষা করার একটি কৌশল মাত্র। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়াকে বুঝায় দু'টি জাতির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া। জাতি আর ধর্ম এই দুটো কি এক? জাতি এবং ধর্ম এক বিষয় না। ধর্ম ও জাতি দুটো আলাদা বিষয়। '৪৭-এর দেশ ভাগের ক্ষেত্রে ধর্মকে জাতি হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাখ্যাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? এখানে প্রশ্নটা চলে আসে তা হলো, ১৯৪৭-এ উপমহাদেশে কি দুটো ধর্মের মানুষই শুধু বাস করত? যদি তা না হয় অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা ভূখন্ড কেন সৃষ্টি হয় নাই? ভারতীয় উপমহাদেশে তখন প্রায় এক হাজার ধর্মের প্রচলন ছিল। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে বা ধর্ম পালনকারী মানুষের হিসেবে হিন্দু এবং মুসলিম ধর্ম পালনকারীরাই ছিল বেশি। তাই এই দুই ধর্মের মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়। এই ভাগ করাটা কোনো আন্দোলনের ফসল নয়। কারণ ভারতে ৩৫টি প্রদেশ আছে। ৩৫টি প্রদেশের জনসংখ্যা অনুপাতে বহু প্রদেশ আছে যেখানে হিন্দু ধর্ম পালনকারীর চেয়ে অন্য হিসেবে চিহ্নিত ধর্মের মানুষ বেশি। ভারতের ছত্রিশগড় রাজ্যে সাওতাল আদিবাসীর সংখ্যা বেশি। এই সাওতাল আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০ এগারটি ধর্ম। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্ব বাংলা যাকে বলা হতো ১৯৪৭ সালে তা পরবর্তী সময়ে এসে পূর্ব পাকিস্তান হয়। এখানেও নানা ধর্মের মানুষের বাস ছিল। দেশ ভাগকে ভারতীয় উপমহাদেশ যেভাবে পৃথক করা হয়েছে, তা কখনোই ধর্মীয়ভাবেও ভাগ করা হয়নি। ভাগ করা হয়েছিল কিছু অভিজাততান্ত্রিক মানুষের ভোগ দখল করার জন্য। ভূখন্ড ভোগ দখল করার বিষয়টিকে জায়েজ করার জন্য দেওয়া হয়েছিল ধর্মীয় প্রলেপ। আর এই ধর্মীয় প্রলেপটাকে বলা হয়েছিল দ্বি-জাতি তত্ত্ব। কারণ পাকিস্তানের নামকরণটা দেখলে বুঝা যায় যে, ভাগের বিষয়ে ধর্মটা মুখ্য ছিল না। বর্তমানে অনেকেই মনে করছেন '৪৭ না আসলে বাংলাদেশ আসত না। এটা অযৌক্তিক কথাবার্তা। আবার কেউ কেউ বলছেন পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলার সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন '৪৭-এর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ বিতাড়িত করে যে পাকিস্তান হয়েছিল তাতে বাংলাদেশ। অধিকারটাও ছিল। এগুলো কথা বলার অর্থ একটাই তা হলো '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। কারণ উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার সময় পাকিস্তান নামকরণের বিষয়টিতে পূর্ব বাংলা শব্দটি ছিল না। পাকিস্তান নামকরণ করা হয় পাঞ্জাবের (পাকিস্তানের অন্তর্গত পাঞ্জাব) চ, সীমান্তে আফগানের অ, কাশ্মীরের (কাশ্মীরের যে অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে) ক, সিন্ধু প্রদেশ থেকে নেওয়া ও এবং বেলুচিস্তানের ঝঞঅঘ এই মিলিয়ে হয়েছিল চঅকওঝঞঅঘ। এখানে বাংলার-ই কোথায়? আজকাল অনেক কথিত রাজনীতিবিদ বিভিন্ন আলোচনায় এবং টকশোতে এসে '৪৭-এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে যুক্তি দেখান। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্ব বাংলা ছিল পাকিস্তানের একটি নতুন উপনিবেশ। পূর্ব বাংলার মানুষের মতামত না নিয়ে ১৯৫৩ সালে পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করা হয়। নবসৃষ্ট রাজনৈতিকরা তাত্ত্বিকতার সুরে ব্রিটিশের উপমহাদেশ ভাগের এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেন, যেন '৪৭-এর দেশভাগের সূত্র ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
তাছাড়া ব্রিটিশ তাড়াতে কথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের কোনো ভূমিকা ছিল না। দ্বি-জাতি তত্ত্বটি ছিল একটি ভোগ দখল করার একটি আবরণীয় আন্দোলন। ১৯৪০ সালের পূর্বে বাংলা ভূখন্ডে কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়নি। দেশ ভাগের নামে কিছু অভিজাত হিন্দু ধর্মপালনকারী মানুষ এবং পাকিস্তানি কিছু মুসলমান ধর্মের মানুষের ইন্ধনে ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাটি হয়। এই দাঙ্গায় যারা নিধনযজ্ঞে যারা বড় ভূমিকা পালন করেছিল তারা কেউ বাঙালি ছিল না। এদের হিন্দু ও মুসলিম অভিজাত পরিবারগুলো ভাড়া করে এনেছিল বিহার থেকে। অনুরূপ ঘটনা ঘটে উপমহাদেশের পাঞ্জাবসহ অন্য প্রদেশে। এই দাঙ্গাটা সংঘটিত করে দ্বি-জাতি তত্ত্বের নেতারা ব্রিটিশদের সঙ্গে বসে দেশ ভাগ করে। এই দাঙ্গা কি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হয়েছিল? তাহলে কেন এই দাঙ্গাকে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া ১৯৪৭ সালে কথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রাপ্ত স্বাধীনতায় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না, তা উপলব্ধি করা যায় ১৯৪৮ সালের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো নিরীক্ষণ করে। ওই সময় সারা পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেন দেশ ভাগের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষের কণ্ঠে বেজে ওঠে এই স্স্নোগানটি 'ইয়ে আজাদী ঝুট হ্যায় লাখো ইনসান ভুখা হায় সাচ আজাদী ছিনকে লও' এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে যায়, ১৯৪৭ সালের কথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের দেশভাগ প্রক্রিয়াতে এ দেশের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না। সুতরাং, দ্বি-জাতি তত্ত্বটি আসলে ব্রিটিশদের দেওয়াই একটি প্রেসক্রিপশান। কারণ বাংলা বিভক্ত হয় দুই ভাগে পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা হিসেবে। পশ্চিম বাংলা অন্তর্ভুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে আর পূর্ব বাংলা অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তানে। এই বিভক্তি কি ধর্মপালন জনসংখ্যার অনুপাতে হয়েছিল নাকি তৎকালীন জমিদারদের ইচ্ছায়। পূর্ব বাংলার সীমান্তবর্তী জেলা মালদাহ ও মুর্শিদাবাদ এই দুই জেলায় বসবাসরত জনসংখ্যার ৮০ ভাগই ওই সময় ইসলাম ধর্ম পালন করত, কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে তারা পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই দুই জেলা অন্তর্ভুক্ত হয় পশ্চিম বাংলায়। অপরদিকে, খুলনা জেলার ৭০ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্ম পালন করত, তথাপি খুলনা জেলা কিন্তু পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ভৌগোলিক ভাগটা করেছিল ব্রিটিশ কর্মকর্তা রেড ক্লিফ, যা ছিল অনেকটা বানরের পিঠা ভাগের মতো। অসংখ্য ছিটমহল ভূমি রেখে এই দেশ ভাগটি হয়েছিল। ছিটমহলবাসীদের সুদীর্ঘ দিন এই কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। দেশ ভাগের দুই নায়ক ছিলেন জিন্নাহ ও নেহেরু। এই দু'জনই ছিল অবাঙালি। জিন্নাহ মুসলিমদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করলেও তিনি কোনো ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন না। যেহেতু নেহেরু ও জিন্নাহ দু'জনের কেউ বাংলার মানুষ ছিলেন না, তাই বাংলা কীভাবে ভাগ হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও ছিল না। বাংলা থেকে এই দেশ ভাগের সময় তেমন উলেস্নখযোগ কেউ প্রতিনিধি না থাকায় বাংলার এই করুণ অবস্থা। যারা মনে করেন '৪৭-এর দেশ ভাগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে সুগম করেছে, তারা ইতিহাসের কিছুই জানেন না। ব্রিটিশ তাড়ানো আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকায় জিন্নাহ মুসলিম লীগ বা নেহেরু কংগ্রেস ছিল না। কারণ ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই দু'টি দলের কোনো নেতাকর্মীরা শহীদ হয়নি ব্রিটিশ তাড়ানো আন্দোলন করতে গিয়ে। ব্রিটিশ তাড়ানো আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত ঘটান সাঁওতালরা। ১৮৫৫ সালে ৩০ জুন সিধু ও কানু দুই ভাই প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তারপর ১৭৫৭ সালে ১০ মে শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন মঙ্গল পান্ডে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষুদিরাম (শহীদ হন ১১ আগস্ট, ১৯০৮), প্রীতিলতা ওয়েদ্দার (শহীদ হন ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২)সহ প্রমুখ সংগ্রামী। এরা কেউ কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের নেতাকর্মী ছিলেন না। ১৯৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাংলা বিহারসহ বিভিন্ন জনপদে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ হয়েছিল তার একটির নেতৃত্বে মুসলিম লীগ বা কংগ্রেস ছিল না। নেতাজী সুভাষ বোস ছিলেন ব্রিটিশ তাড়ানো আন্দোলনের মূল নায়ক। তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্বে ভিত্তিতে নয়, ভারতকে ব্রিটিশ শোষণমুক্ত করতে সশস্ত্র সংগ্রামী আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন।
ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে যে পরিমাণে লুটতরাজ করেছে তার হিসাব আদায় করার উদ্দেশ্য ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের। তাই নিজেদের রক্ষার্থে ব্রিটিশরা দ্বি-জাতি তত্ত্বের অবতারণা ঘটায় সুকৌশলে এবং ধর্মীয় প্রলেপে উপমহাদেশকে দু'ভাগ করেন। সুতরাং, ১৯৪৭-এর দেশ ভাগ কোনো আন্দোলনের ফসল বলা যাবে না। যারা ১৯৪৭-এর ভাগকে ভিত্তি ধরে '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে হিসাব করেন, তারা পাকিস্তানি বিশ্বাসী। কারণ '৪৭-এ দেশের ভাগের ফলে পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশ) হয় পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশ।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক