১৯৯৬ সালে ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি ৮ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) মতে, একজন রোগী কোনো
প্রকার রেফারেন্স ছাড়াই সরাসরি একজন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন। ফিজিওথেরাপি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসাব্যবস্থা, যেখানে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াবিহীন শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট সাধারণত অসুস্থতা, আঘাত ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থেকে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা নির্ণয় ও চিকিৎসার কাজ করেন। ফিজিও থেরাপিস্টরা সাধারণত চার বছরের একাডেমিক কোর্স ও এক বছরের ইন্টার্নশিপ কোর্স সম্পন্ন করেন। দেশ-বিদেশি তাদের চাকরির বেশ কিছু সুযোগও আছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্ট যেমন ফুটবল, হকি, ভলিবলসহ অন্যান্য জাতীয় দলে ফিজিও কনসালট্যান্টের কাজ করার সুযোগ থাকে।
দেশে বর্তমানে ফিজিও থেরাপিস্টদের সরকারিভাবে তেমন নিয়োগ হয় না বললেই চলে। উন্নত বিশ্বে ফিজিওথেরাপিস্ট অন্যতম পছন্দের পেশা হলেও বাংলাদেশে এই পেশা এখনো অনেক চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় আছে। দীর্ঘমেয়াদি রোগ, বিশেষ করে বাত-ব্যথা ও পক্ষাঘাতের রোগীদের সমস্যা ওষুধ দিয়ে নিরাময় সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা। বিভিন্ন ফিজিওথেরাপিস্টদের মতে 'ফিজিওথেরাপি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অন্যতম এবং একটি অপরিহার্য শাখা। শুধু ওষুধ সব রোগের পরিপূর্ণ সুস্থতা দিতে পারে না। বিশেষ করে বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা থেকে যেসব রোগের সৃষ্টি হয়, এর পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের উপায় ফিজিওথেরাপি। আর এ জন্য সরকারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ এখন সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে।'
১৯৬০ সালে বাংলাদেশে প্রফেসর ডা. আবুল হোসেনের হাত ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগ চালু হয়। পরে দেশের কয়েকটি হাসপাতালে এই বিভাগ চালু হলেও মুক্তিযুদ্ধের পর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল তথা পঙ্গু হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা ও চিকিৎসা কার্যক্রম বড় পরিসরে শুরু হয়। ফিজিওথেরাপির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে দেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে মোট আটটি প্রতিষ্ঠানে এই কোর্সটি পড়ানো হয়। তাই প্রয়োজনের তুলনায় দেশে ফিজিওথেরাপিস্টদের সংখ্যা খুবই কম। বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা যেকোনো সংগ্রামে আহত ব্যক্তিদের জন্য ফিজিওথেরাপিস্টদের প্রয়োজন। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সেবায়ও এগিয়ে এসেছেন ফিজিওথেরাপিস্টরা।
সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে ১৯৭২ সাল থেকে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন 'বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি সোসাইটি (বিপিএস)। সেখানে জানানো হয় ২০০০ সালের ভেতর সরকারিতে কর্মরত প্রফেসর ডা. মনিরুজ্জামানের মতো ফিজিওথেরাপি পেশার প্রাণপুরুষরা অবসরে চলে গেলে নতুন করে আর ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ না হওয়ায় শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ডিপার্টমেন্টগুলো বেদখল হয়ে যায়। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে 'ফিজিওথেরাপিস্ট' পদে কোনো ফিজিওথেরাপিস্ট কর্মরত নেই। পঙ্গু হাসপাতালে যেই ফিজিওথেরাপি বিভাগটি চালু আছে, তাও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে চালানো হচ্ছে। সরকারিতে ফিজিওথেরাপিস্ট না থাকায় পুরো ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পেশাটা টিকে আছে বেসরকারিভাবে ফিজিওথেরাপি সেন্টার এবং কিছু এনজিও আশা, সিআরপি কেন্দ্রের মাধ্যমে। এতে করে প্রকৃত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, কেওয়াক দিয়ে চলছে পুরো ব্যবস্থাটি, অপরদিকে ফিজিওথেরাপিস্ট চিকিৎসকরা সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন, আবার অনেকে ব্যক্তিগত চেম্বার দিয়ে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দিচ্ছেন। এতে করে ভালোনের ফিজিওথেরাপিস্টদের চিকিৎসা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে এই সেবার সুযোগ না থাকায় অনেকেরই যথাযথ চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘমেয়াদি রোগের সৃষ্টি হচ্ছে, কনসার্ভেটিভ চিকিৎসায় সুফল পেত, সেটা অপারেশন করতে বাধ্য হচ্ছে, কেউ কেউ চিকিৎসার অভাবে প্রতিবন্ধীর ঝুঁকিতে রয়েছে এবং কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিশুরা যথাযথ ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশনের অভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পেরে পরিবারের বোঝা হচ্ছে। এ ছাড়াও মাসল ইনজুরি, আর্থ্রাইটিস, কোমর ব্যথা, স্ট্রোকসহ নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, জয়েন্ট ব্যথা, হাড়ের অপারেশন-পরবর্তী ফিজিওথেরাপি, স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি, রেসপিরেটরি ফিজিওথেরাপি, আইসিউ ফিজিওথেরাপি, গাইনেকোলজিক্যাল ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি সেক্টরে ফিজিওথেরাপিস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন। এতোগুলো সেক্টরের কোথাও রোগী ফিজিওথেরাপি ব্যবস্থা পায় না কারণ সরকারিভাবে হাসপাতালগুলোতে সে ব্যবস্থা নেই। যাদের সামর্থ্য আছে এবং সচেতন তারা ব্যক্তিগত চেম্বারে ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন আবার অনেক সামর্থ্যবান সরকারি সেক্টরে ব্যবস্থাপনার অভাবে বিদেশে গিয়ে এ ধরনের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে বাত-ব্যথা ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে তাই ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। আশা করি, নতুন সরকার এ বিষয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিবে।
কেএম মাসুম বিলস্নাহ
ঢাকা।