কয়েক হাজার বছর আগে ইতিহাসের জনক খ্যাত হেরোডোটাস বলে গেলেন, রাজনৈতিক অনিয়ম যখন সবচেয়ে বড় নিয়ম হয়ে যায় তখন সভ্যতাকে রক্ষার দায়িত্ব প্রকৃতির ওপর বর্তায়। একটি দেশের শাসনব্যবস্থা জনবান্ধন করতে সেপারেশন অব পাওয়ার অর্থাৎ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থাকলে স্থানীয় সরকারগুলো তারা নিজেদের কর্মভার সুনির্দিষ্টভাবে সাজিয়ে নিতে পারে। যা স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, জনগণের সঙ্গে দূরত্ব কমায়। যার বাস্তব উদাহরণ দেখা যায় জার্মানিতে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের অন্যতম মূল ভিত্তি, যার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়ে থাকে। এ জন্য প্রধান বিচারপতিকে কোনো রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে দলমত নির্বিশেষে সবার বিচারপতি হতে হয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ বিচারপতিরা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকে। সরকারের প্রভাবশালী মহল থেকে বিচার বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করলে প্রায় বিচারপতিরা তা সামলাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বড় অভাব। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করলে জনগণ সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না বৈকি। এ জন্য কাগজ-কলমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন দেখানোর পাশাপাশি বাস্তবিকভাবে এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বিচার বিভাগকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে নিয়ে আসা অতীব জরুরি। ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেমন ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্পদের ব্যবধান দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতি করার মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ টাকা নিজেদের কবলে আয়ত্ত করে নিয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ ঘরোয়া ও বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো নিয়ে ঝুঁকছে। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমতা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন অনস্বীকার্য। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মানসম্মত শিক্ষা পেলে অর্থনৈতিক সমস্যা দূরীকরণ হওয়া সম্ভব। এ জন্য তাদের বৃত্তি প্রদান করতে হবে। দরকার হলে তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে ও ক্ষুদ্র ঋণের মতো সুযোগ-সুবিধা তাদের দেওয়া যেতে পারে। আমাদের অর্থনৈতিক চাকাকে আরও সমৃদ্ধশালী করতে বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। যার মাধ্যমে তারা যেমন গ্রামীণ উন্নয়নে সাহায্য করতে পারবে, তেমনি দক্ষ জনবল হয়ে বিদেশি উচ্চ মজুরিতে চাকরি করতে পারবে। মানসম্মত শিক্ষা বিস্তার করতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠ্যক্রম আধুনিকীকরণের বিকল্প নেই। এই জন্য গৎবাঁধা পাঠ্যক্রম না রেখে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রাখা উচিত। যা শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তিকে সৃজনশীল ও বিকশিত করবে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠদান করতে মাঝে মধ্যে ব্যাকফুটে থাকতে হয়। যার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এই সেক্টরে বাজেটের অপ্রতুলতা। যা প্রায় মোট বাজেটের ২ শতাংশের চেয়েও কম। যার ফলে এই খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। শিক্ষা খাতে অতিসত্ত্ব্বর বাজেট বাড়াতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকরা যোগ্যতার চেয়ে রাজনীতির বলয়ে যুক্ত হওয়ার কারণে নের্তৃত্বগুণের অভাবে শিক্ষার স্বাভাবিক ও সৃজনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় না। যার জন্য দক্ষ ও যোগ্য লোককে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান করতে হবে। জনগণের জীবনমান উন্নত করতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের বিকল্প নেই। পরিবর্তনই পারে একটি দেশের ইতিহাসের মোড় বদলে দিতে, চিন্তার জগৎ এই সৃজনশীলতা বয়ে আনতে। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা হয়েছে, কর্তৃত্ববাদী সরকারকে কুক্ষিগত হতে বাধ্য হয়েছে, সেই বাংলাদেশ দক্ষ ও যোগ্যদের হাতে থাকুক। চতুর্থ শিল্পবিপস্নকে সামনে রেখে বাংলাদেশের পরিবর্তন নিশ্চিত হোক- সেই কামনা করে।
মো. রাসেল হোসেন
ঢাকা।