ফেনী নদী ও ভূ-রাজনীতি
প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি
প্রাকৃতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই ফেনী নদী কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় 'বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)' দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বুঝতে পারব। তার হত্যাকারীরা ছিল স্বৈরাচার হাসিনার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য। মেধাবী আবরার বাংলাদেশের সঙ্গে পানিবণ্টনসহ ভারতের সঙ্গে চুক্তির সমালোচনা করে তার ফেসবুক পোস্ট করেছিল। ফাহাদ বলেছিলেন, হাসিনার নয়াদিলিস্ন সফরের সময়, বন্দর ব্যবহার, জল ভাগাভাগি এবং জ্বালানি সম্পদ রপ্তানির মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
ফেনী নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি শ্রেণি থেকে উৎপন্ন হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানার পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ত্রিপুরাকে পৃথক করে আলীগঞ্জ পর্যন্ত এবং এরপর বঙ্গোপসাগরে পড়ার আগে নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামকে বিভক্ত করে সমতলভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলার বেলছড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রামগড় (খাগড়াছড়ি), ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) হয়ে প্রবাহিত হয়ে এবং চট্টগ্রাম (মিরসরাই উপজেলা) ও ফেনী (ছাগলনাইয়া, ফেনী, সোনাগাজী উপজেলা) জেলার সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়ে ১০৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর সোনাগাজীর কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। রামগড় পর্যন্ত এই নদী দিয়ে ৮০.৫ কি. মি. ছোট নৌকায় সারাবছরই চলাচল করা যায়। বর্ষার বৃষ্টির সময় এটি জলে পূর্ণ থাকে, কিন্তু জলাভূমি এলাকায় ভারী বর্ষণের দ্রম্নত স্রোত এই এলাকা পস্নাবিত হয়। পাহাড়ের ঢাল থেকে বেপরোয়া কাঠ গাছ কাটার ফলে নদীটি ক্রমশ পলিতে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ের ব্যাপক ভাঙন ঘটছে।
ফেনী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ফেনী নদী বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর দুর্বলতা। এই নদীটি বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করে। ফেনীকে তলিয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক বন্যা এই করিডোরের ভঙ্গুরতা এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব তুলে ধরেছে। কারণ, ফেনী নদীর উত্তরে কুমিলস্না এবং দক্ষিণে চট্টগ্রামের সঙ্গে সীমানা ভাগ করে, উভয়ই অঞ্চলের পরিবহণ এবং অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সড়ক ও রেলপথের জন্য একটি অনিবার্য ট্রানজিট পয়েন্ট, যা বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দর শহর এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ স্থাপন করে। তিনটি উলেস্নখযোগ্য নদী ্ত মুহুরী, ফেনী এবং সেলোনিয়া ্ত ফেনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যা জেলার কৌশলগত গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নদীগুলি শুধুমাত্র স্থানীয় কৃষিকেই লাভবান করে না, বরং ভারতের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত পানিকে 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
আন্তঃসীমান্ত নদী ফেনীতে দ্বিতীয় এমওইউতে সমঝোতা স্মারকে, বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ভারতের ১.৮২ কিউসেক (ঘন ফুট প্রতি সেকেন্ড) পানি প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল, যা পানি সংকটের মধ্যে থাকা সাব্রম্নম শহরের পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রম্নম, বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে, তবে এটি কার্যত একটি স্থলবেষ্টিত অঞ্চল। ফেনী নদীর পানি ব্যবহার করে ভারতীয় সেচ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের উত্তর ফটিকছড়ি, শুভপুর, সোনাগাজী ও মিররশরী মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশকে তার বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্প পরিত্যাগ করতে হবে এবং পুরো এলাকার পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। ভারত বাংলাদেশের রামগড়ের সঙ্গে সাব্রম্নম (ত্রিপুরার) সংযোগের জন্য, ফেনী নদীর ওপর একটি ১৫০-মিটার দীর্ঘ, ৪-লেনের সেতু ৭২ কোটি রুপি আনুমানিক ব্যয়ে ভারতের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। যাতে স্থলবেষ্টিত সীমান্ত শহরটি বাংলাদেশের রামগড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এই সেতুটি বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে সরাসরি প্রবেশের পথ খুলে দিয়েছে। সাব্রম্নম থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার, যেখানে সাব্রম্নম থেকে আগরতলার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। বর্তমানে, ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ পশ্চিমবঙ্গের একটি সরু করিডোরের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে, যা 'চিকেনের নেক' নামে পরিচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি রাস্তা দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করেছে।
এদিকে আরাকান আর্মি (এএ) চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছে। চিন্ডউইন নিউজ এজেন্সির রিপোর্ট অনুসারে, আরাকান আর্মি চিন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পালেতওয়া অঞ্চলে প্রবেশ না করার জন্য বলেছে। এএ এই বছরের শুরুতে চিন রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরটি দখল করার পর নিজস্ব শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এএ-এর কর্মকান্ডের ফলে শত শত পালেতোয়া বাসিন্দা ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পালিয়েছে। এএ এর বিষয়ে মার্কিন সরকার ও পেন্টাগনের আগ্রহ আছে। এএ, শান রাজ্যে জাতিগত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, রাখাইনজুড়ে তাদের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এএ, ভামো-মিইটকিনা হাইওয়ে বরাবর সামরিক ক্যাম্প দখল করার পর চীনের সঙ্গে একটি প্রধান বাণিজ্য পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই অঞ্চলে রয়েছে চীনের ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ। যা কৌশলগতভাবে এই অঞ্চলে মার্কিন সরকার ও পেন্টাগনের জন্য চিন্তার বিষয়। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা ও এএ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই বাংলাদেশের জন্যও চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ২৭১-কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
বেশ কিছু বছর যাবৎ চীনের আধিপত্য খর্ব করার জন্য বাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটির জন্য যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া। এদিকে 'বাংলাদেশ, ভারতের কিছু অংশ যেমন- সেভেন সিস্টার ও মিয়ানমারে আরাকান নিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র :' এই কুখ্যাত এজেন্ডা নিয়ে একটি গ্রম্নপ গোপনে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) পরেশ বড়ুয়াসহ বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। গত বছর শেখ হাসিনা ১৪-দলীয় জোটের নেতাদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার থেকে অংশ নিয়ে 'পূর্ব তিমুরের মতো একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র' গঠনের ষড়যন্ত্র চলছে।
পেন্টাগন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রম্নতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কাজ করতে চায়। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে পেন্টাগন প্রেস সেক্রেটারি মেজর জেনারেল প্যাট রাইডার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের একটি প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে।' অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে বিমানঘাঁটি স্থাপন করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন কক্সবাজার-টেকনাফ উপদ্বীপের অগ্রভাগের প্রায় ৯ কি. মি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশে একটি ছোট দ্বীপ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দিকে নজর রেখেছে। তবে, একটি সংবাদ সম্মেলনের সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জোর দিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিষয়ে কোনোও আলোচনায় জড়িত ছিল না বা এটি করার কোনো ইচ্ছাও নেই। সুতরাং বলা যায়, ফেনী নদী ও এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি।
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি
ঢাকা।