আত্মহত্যা ও রাষ্ট্রের পদক্ষেপ
প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অলোক আচার্য
আত্নহত্যা দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করছে বা উচ্চশিক্ষায় পড়া একজন শিক্ষার্থী অতি তুচ্ছ কারণে কেন আত্মহত্যা করছে সেই মনস্তত্ত্বই এখন আলোচনার বিষয়। এভাবে প্রাণ ঝরলে সমাজের আর কি অবশিষ্ট থাকে? এই মনস্তত্ত্ব কিভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব সেই গবেষণা সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। দেশের অনেক সমস্যার মধ্যে এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এই সামাজিক ব্যাধি না সারালে ক্ষত ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে। অতি মূল্যবান একটি জীবন স্বেচ্ছায় সমাপ্তি টানার ঘটনা বৃদ্ধি আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। দেশে আত্মহত্যাজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছেন ৫১৩ জন শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে ৬০ ভাগেরও বেশি নারী শিক্ষার্থী। আরও উদ্বেগের বিষয়, যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে ৪৪ ভাগেরও বেশি স্কুল শিক্ষার্থী। আঁচল ফাউন্ডেশন তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সংগঠনটি জানিয়েছে, নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আত্মহননের পথ বেছে নেওয়াদের মধ্যে ৬০ দশমিক ২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের তুলনায় স্কুলমুখী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করেছে তারা। তার পরিমাণ ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৩ সালে যে ৫১৩ জন আত্মহত্যা করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ২২৭ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ১৪০ জন কলেজ শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন এবং ৪৮ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।
যারা আত্মহত্যা করেছে তারা মেধাবী এবং এই জাতির ভবিষ্যৎ শক্ত হাতে ধরতে পারত, তাদের ওপর নির্ভর ছিল কিছু পরিবার, তাদের ঘিরে স্বপ্ন ছিল অসংখ্য মানুষের। তবুও তারা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। কেন তারা এ পথ বেছে নিল? একজন শিক্ষার্থীর চোখে থাকে অনেক ধরনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণে থাকে বহুমুখী বাধা। সেই বাধা আসতে পারে যে কোনো অবস্থান থেকে। সেই বাধা অতিক্রম করে বিজয়ী হওয়ার নামই জীবন। আর্থিক সমস্যা থাকতে পারে, প্রেম ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু সবার ওপর জীবনটা যে অনেক সুন্দর সেই সত্য বোঝার ক্ষমতাও থাকতে হবে। যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারা কেউ আমাদের ভবিষ্যৎ ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার বা দক্ষ প্রশাসক হতে পারত। সর্বোচ্চ শিক্ষিত এসব তরুণ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। তবুও তাদের আত্মহত্যা করতে হলো। এখানে ভাবার বিষয় হলো আমাদের পারিবারিক জটিলতা এবং সম্পর্কের টানাপড়েন ইদানীং সময়ে প্রচন্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান না হলেও সারা বিশ্বেই কম-বেশি আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে তার একেবারে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে 'অভাব' শব্দটির সঙ্গে তার যোগ রয়েছে। সেই অভাব কেবল বস্তুগত চাহিদার নয় বরং মনেরও বটে।
শিক্ষার্থীর বাইরেও বহু নারী-পুরুষ আমাদের দেশে আত্মহত্যা করে বহু মানুষের মৃতু্য ঘটেছে। এই সংখ্যা অনেক ক্ষেত্রে করোনায় মৃতু্যর সংখ্যার চেয়েও বেশি। করোনা তো একদিন শেষ হবে। আত্মহত্যার মিছিল কি শেষ হবে? যে হারে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রেম নিয়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হচ্ছে, পরকীয়া সমাজকে অক্টোপাসের মতো আকড়ে ধরছে, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে, মাদক তার ভয়াবহ বিস্তার ফেলছে সেখানে নানামুখী জটিলতায় জীবন আটকে যাচ্ছে। এই জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতেই কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে মানসিক শক্তির দুর্বলতাও দায়ী। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে নিজেই সমস্যা থেকে মুক্তি খুঁজছি। কেউ আমার সঙ্গে অন্যায় করলে এর প্রতিবাদ না করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। আদতে এটা কোনো সমাধান নয়। সমাধান হলো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো। এই মানসিক শক্তি আজকাল মনে হয় খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের গত বছর দেওয়া এক তথ্যে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছে। আবার এক জরিপ থেকে জানা যায়, গত দুই বছরে অর্থাৎ ২০২১ ও ২০২২ সালে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রুয়েটেরই ১১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এসব ঘটনার পেছনে পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট ইত্যাদি কারণ রয়েছে। ঘুরে-ফিরে এ কারণগুলো আত্মহত্যার পেছনে দায়ী থাকছে। ব্যক্তি ও পরিস্থিতি ভেদে আত্মহত্যার কারণ ভিন্ন। কেউ সবকিছু পেয়ে আত্মহত্যা করছে আবার কেউ কিছু না পাওয়ার ক্ষোভে আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি এমন এক মানসিক অবস্থায় পৌঁছে যায় যখন সে বাস্তব যুক্তিতর্কের বিবেচনা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে আত্মহত্যা করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। আত্মহত্যা একটি অপ্রত্যাশিত এবং অমীমাংসিত সমাধান। যদিও সাময়িকভাবে আত্মহত্যাকরীরা তাদের জীবনের নানামুখী সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয় তথাপি তারা নিজেদের সরিয়ে নিয়ে পরিবার-পরিজনদের আরও বেশি চাপের ভেতর ফেলে দেয়।
বাংলাদেশে আত্মহত্যা করার পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ রয়েছে। পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং দূরত্ব তৈরি হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করা, কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পাওয়া, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে, ঋণ থেকে মুক্তি পেতে, মানসিক সমস্যাজনিত কারণে মাদকদ্রব্যে আসক্ত হলে ইত্যাদি আরও অনেক ছোট-বড় বহু কারণ রয়েছে। সামান্য মানসিক উদ্বিগ্নতা তৈরি হলেই মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যে সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত সহজ সে সমস্যার জন্যও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে যে কারণেই আত্মহত্যা করুক না কেন তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার শুধু আত্মহত্যার চেষ্টা করে তা থেকে বেঁচে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি। আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছেলে বা মেয়ে তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যা করছে। আমাদের এই প্রজন্মের এসব মেধাবী ছেলেমেয়ে যদি আত্মহত্যার মতো অপ্রত্যাশিত অপরিমাণদর্শী চিন্তাভাবনার পথ বেছে নেয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আমরা কোথায় দাঁড়াব। একেকজন একেক কারণে জীবনের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আজকাল মানসিক চাপকে অনেকেই দোষারোপ করছেন। বর্তমান প্রগতির যুগে অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে কিন্তু আত্মহত্যা মানসিক চাপ কমানোর যে কোনো সমাধান নয় বরং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সে কথা বুঝতে হবে। নিজেকে শেষ করে কোনো সমস্যার সমাধান আশা করাটা বোকামি বরং সমস্যার মাঝ থেকে সমস্যাকে-বাধাকে অতিক্রম করতে হয়। এটাই নিয়ম। নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলে কোনো সমাধান হয় না।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাধান কোথায়? কিভাবে এই সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। তারপর সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। জীবনে হতাশ হওয়ার যেমন কারণ রয়েছে তেমনি জীবনকে ভালোবাসার মতো কারণও রয়েছে প্রচুর। বর্তমান সমাজে হতাশা নামক ব্যাধি খুব সহজেই মানুষের মনে বাসা বাঁধছে। এই হতাশা কাটাতেই অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন হালকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব হতাশ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সামাজিক অস্থিতিশীলতা, চাকরির বাজারের অস্থিরতা, সম্পর্কের টানাপড়েন, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের অভাব, ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধের অনুপস্থিতি, মাদকদ্রব্যের বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়া, সন্তানের বেড়ে ওঠায় একাকীত্ব এসব কিছুই তার ব্যক্তিজীবনের ওপর শ্রদ্ধাবোধ আলগা করতে ভূমিকা রাখে। জীবনকে ভালোবাসার চেয়ে ভালো আর কোনো কিছুই হতে পারে না। প্রথমে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে হবে। মানসিক শক্তি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকেই আজকাল মেডিটেশনের সাহায্য নিচ্ছে। মেডিটেশন হতে পারে মানসিক চাপ কমানোর কার্যকর উপায়। জীবন একটি ঘটনায় থেমে থাকে না। প্রত্যেকেরই কিছু করার সুযোগ থাকে। এভাবে মনকে দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে। একজন ছেলেমেয়ে যখন কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে তখন তার পরিবার তাকে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখে তা একটি সাজানো গোছানো ভবিষ্যতের। দেশও তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে। এখানেই রয়েছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তার চাকরির নিশ্চয়তা রাষ্ট্র্রকেই দিতে হবে। তার লেখাপড়া শেষ করে যদি চাকরি না করতে পারে বা কোনো কর্মসংস্থানে না যায় তাহলে সে হতাশ হবেই। সুতরাং এখানেই রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। কেউ যেন আত্মহত্যা না করে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
অলোক আচার্য
পাবনা