রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ব্যাংক দেউলিয়া হলে গ্রাহকের টাকার পরিণতি কী হবে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি। অনিয়ম, জালিয়াতি এবং লুটপাটের কারণে একাধিক ব্যাংক দেউলিয়ার পথে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ব্যাংক দেউলিয়া হলে গ্রাহকের টাকার পরিণতি কী হবে

ব্যাংকিং খাত একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মেরুদন্ড। যে কোনো ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা জাতীয় অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে সম্প্রতি একাধিক ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নাম উলেস্নখ না করে জানিয়েছেন, দেশের ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। এই সংবাদ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে যারা তাদের সঞ্চিত অর্থ এসব ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বহু বছর ধরে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে- যার মধ্যে প্রধান হলো জালিয়াতি, খেলাপি ঋণ এবং লুটপাট। বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক, বিশেষ করে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো, তাদের প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অনিয়মের কারণে দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। একাধিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকটের কারণে বর্তমানে ব্যাংকিং খাত এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি।

অতি সম্প্র্রতি গ্রাহকরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তড়িঘড়ি করে তাদের আমানত উত্তোলনের চেষ্টা করছেন, বিশেষ করে তারা যখন জানতে পেরেছেন যে কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা বেশিরভাগই নিজেদের টাকা উঠাতে পারছেন না, ফলে এ নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

যদি একটি ব্যাংক সত্যিকার অর্থে দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে গভীর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের আমানত সুরক্ষা আইন-২০২০ অনুযায়ী, একটি ব্যাংক দেউলিয়া হলে গ্রাহকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন। তবে, যদি গ্রাহকের ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২ লাখের বেশি হয়, সেক্ষেত্রে সেই বাড়তি অর্থ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হতে পারে।

এরপর ৯০ দিনের মধ্যে দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকটি আমানতকারীদের বিস্তারিত তথ্য ও আমানতের পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দাখিল করবে। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে বীমা তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে বাকি অর্থ ফেরত দেয়া হবে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়া দেরিতে বা অসম্পূর্ণ হতে পারে।

২০২০ সালে প্রণীত আমানত সুরক্ষা আইনটি ব্যাংক দেউলিয়া হলে গ্রাহকদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য করা হয়েছে। তবে, এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ব্যাংক দেউলিয়া হলে সর্বাধিক ২ লাখ টাকা প্রদান করা হলেও, অনেক গ্রাহকের ক্ষেত্রে তাদের মোট আমানত ২ লাখ টাকার চেয়ে বেশি হতে পারে। এই সীমাবদ্ধতা অনেক গ্রাহককে অসন্তুষ্ট করছে, কারণ তারা তাদের পূর্ণ সঞ্চয় ফেরত পাবেন না।

এছাড়াও, যদি কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় এবং তাদের তহবিলে গ্রাহকের পাওনা পরিমাণ না থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট সুদের হারে দেউলিয়া ব্যাংককে ঋণ প্রদান করবে। এর মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের গচ্ছিত অর্থ কিছুটা হলেও ফেরত পাবেন। তবে এর ওপরেও নির্ভর করে যে দেউলিয়া ব্যাংকের কতটা ঋণদানের ক্ষমতা বা সম্পদ অবশিষ্ট রয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বহু বছর ধরে বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির শিকার হয়েছে। খেলাপি ঋণ, জালিয়াতি এবং লুটপাটের কারণে অনেক ব্যাংক কার্যত ধ্বংসের পথে। বিশেষ করে, কিছু ব্যাংক বড় ব্যবসায়িক গ্রম্নপের সঙ্গে মিলে একাধিক ঋণ বিতরণে অনিয়ম করেছে। এর ফলে, ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা গ্রাহকদের সঞ্চিত টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করা হলেও, তা টেকসই সমাধান আনতে পারেনি। ২০১৮ সাল থেকে বেশ কয়েকবার বাজারে নতুন টাকা ছাপানো হয়েছে- যার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করা হয়েছে। তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়, কারণ এটি শুধু মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে এবং অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করেছে।

যদি এক বা একাধিক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে তার প্রভাব অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে গভীরভাবে অনুভূত হবে। ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ব্যাংক দেউলিয়া হলে অর্থনীতি মন্দার দিকে যেতে পারে, কারণ ব্যবসায়িক ঋণ, বিনিয়োগ এবং দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হবে।

এছাড়া, গ্রাহকরা ব্যাংকের ওপর আস্থা হারাতে পারেন- যার ফলে, ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকিং খাতের এমন একটি সংকট পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধাক্কা দিতে পারে এবং এতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল দায়িত্ব হলো ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশ্বাস দিয়েছেন যে, ব্যাংক দেউলিয়া হলেও গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, ব্যাংকগুলোকে আর তারল্য সুবিধা দেওয়া হবে না- যা পূর্ববর্তী গভর্নরের সময়ে করা হয়েছিল।

এটি ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকগুলো যদি নিজেরা তাদের তারল্য সংকট সমাধান করতে না পারে, তাহলে অনেক ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কার্যকর এবং কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে- যাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা পুনর্গঠন করা যায়।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করতে হলে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আমানত সুরক্ষা আইনকে আরও উন্নত করতে হবে- যাতে গ্রাহকরা তাদের পুরো সঞ্চয় ফেরত পেতে পারেন। এটি ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা বাড়াতে সাহায্য করবে।

তৃতীয়ত, ব্যাংকগুলোকে নিজেদের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং যথাযথ পরিমাণে তারল্য বজায় রাখতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে হবে- যারা ব্যাংক পরিচালনায় দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হবেন।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি। অনিয়ম, জালিয়াতি এবং লুটপাটের কারণে একাধিক ব্যাংক দেউলিয়ার পথে।

এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। আমানত সুরক্ষা আইন-২০২০ গ্রাহকদের কিছুটা সুরক্ষা দিলেও, তা পর্যাপ্ত নয়। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের উচিত একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করা- যাতে ভবিষ্যতে এমন সংকট আর না দেখা দেয়। ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে একটি শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল :চিকিৎসক ও লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে