পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনতান্ত্রিক, ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পুলিশিং ব্যবস্থা, নিরাপত্তা কাঠামো, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থাসহ সর্বক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পদক্ষেপগুলো ছিল সর্বসাধারণের সঙ্গে নিষ্ঠুর মশকরা। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান আজিজ আহমেদ এবং এনবিআর পরিচালক মতিউর রহমানের দুর্নীতির কেচ্ছাকাহিনী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকতেই সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ছাড়া দেশের বোর্ড পরীক্ষা, চাকরির প্রশ্নপত্র, মেডিকেলে ভর্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, এমনকি বিসিএসের প্রশ্ন পর্যন্ত ফাঁস হয়েছে। অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ছড়িয়ে দিয়ে হাসিনা দুর্নীতিকে সর্বগ্রাসী প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করেছিল। দুর্নীতির ব্যাপারে শেখ হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রচন্ডভাবে আশকারা দেওয়ার শামিল। নানা কারণেই জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ ধূমায়িত ছিল, ৫ আগস্টের গণ-অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে তা এপ্রোভাল হয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে ঠেকেছিল যে, একটা ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও দাবানল সৃষ্টি হওয়ার মতো অবস্থা বিরাজ করছিল। যার পরিণতিতে দেশে জুলাই-আগস্ট মাসে গণঅভু্যত্থান ঘটে।
বাংলাদেশের জেনারেশন-জেড (জেন-জি) আন্দোলনের ফসল বিএনপি ভোগ করার জন্য অস্থির। বিএনপির পথ পরিষ্কার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই। কাজেই তাদের জন্য খালি মাঠে গোল দেয়া একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও সময় দিতে রাজি নন। কবে, কীভাবে নির্বাচন দিতে হবে, কবে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা হবে, বা করতে হবে, তাই নিয়ে বিএনপি ব্যস্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অতি দ্রম্নত সংলাপ চেয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারে তাদের বিশ্বাস নেই। নির্বাচন অবশ্যই 'সীমিত' সময়ের মধ্যে করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, রাষ্ট্র মেরামত করবে নির্বাচিত সরকার। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সংলাপ চেয়েছেন। তিনি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণারও দাবি করেছেন।
বিএনপি নেতাদের এত তাড়াহুড়া কেন? সাড়ে ১৫ বছর সইতে পারছেন, আর না হয় কিছু দিন অপেক্ষা করুন। কেন এত অস্থিরতা? ছাত্ররাতো রাষ্ট্র মেরামতের ঘোষণা দিয়ে স্বৈরাচার বিদায়ে একদফা দাবি ঘোষণা করেছিল। অপেক্ষা করুন, দেখুন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র মেরামত করতে পারে কিনা।
বিএনপি বলছে, তারা রাষ্ট্র মেরামত করবে, বিএনপির শাসনামল আমরা ভুলিনি! তারা কি খুব সহজেই রাষ্ট্র মেরামত করতে পারবে? বিএনপি মহাসচিবকে বলতে চাই, আপনারা আমাদের কাছে অপরীক্ষিত নন। আপনাদের শাসনামল/সংস্কার দেশবাসী ভুলেনি। রাষ্ট্র সংস্কার স্বাধীনতার পর থেকেই চলছে। কখনো একদলীয় শাসন, কখনো সেনা শাসন, কখনো এক ব্যক্তির শাসন, বাংলার জনগণ দেখেছে। গণতন্ত্রের দাবিতে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ও পিওর গণতন্ত্রের স্বাদ এবং সুফল এ জাতির ভাগ্যে খুব একটা জোটেনি; বরং জাতি হিসেবে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে বহুবার পরিচিত হয়েছি অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। গণতন্ত্রের নামে এ দেশে স্বজনতোষণ, স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র আর একনায়কতন্ত্রই বিরাজমান ছিল।
আগের সরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, সেগুলোর নূ্যনতম মেরামত না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। রাষ্ট্র মেরামতের কাজ আপাত দৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করেছে মাত্র। কাজেই বিএনপিকে বলছি, আপনার একটু ধৈর্য ধরুন। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে। ড. ইউনূস একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাকে শিক্ষার্থীরাই রাষ্ট্র মেরামত করার দায়িত্ব দিয়েছে। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের ধরা হচ্ছে। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটকারী, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অবৈধ অর্থ আত্মসাৎকারীসহ সবাইকে ধরা হচ্ছে। এসব কাজ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থেকে কতটুকু করতে পারবে?
দেশ আগে থেকেই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়, দুর্নীতি ও ভিন্নমতের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের কারণে সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ ছিল। নির্দিষ্ট ও স্বল্প আয়ের মানুষ জীবন চালাতে হিমশিম খেলেও সাবেক সরকার সব সময় অর্থনীতির একটি রঙিন চিত্র এঁকে গেছে। জবরদখলকারী হাসিনা সরকার তাদের বৈধতার জন্য মুখে দুটি বয়ান দিয়ে আসছিল। তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে দলকানা ব্যাখ্যা ও উন্নয়নের বয়ান। এটা ঠিক দেশে কতগুলো চোখে পড়ার মতো উন্নয়নকর্ম হয়েছে। কিন্তু হাসিনার উন্নয়নের বয়ান মানুষ গ্রহণ করেনি। কারণ, দেশের সর্বত্র দুর্নীতি ও ভিন্ন মতাদর্শদের ওপর বঞ্চনার সঙ্গে মানুষ বাজারে গিয়ে হিসাব মেলাতে পারেনি।
শেখ হাসিনা একা এক আমলে যে ক্ষতি করে গেছেন তা সারতে বহু দিন, বহু বছর লাগবে। শেখ হাসিনা সরকারের আচরণ ছিল মানুষের প্রতি প্রভুসুলভ। এসব কারণেই আমরা দেখেছি ৫ আগস্টের পর দেশের সর্বসাধারণের আনন্দ-উলস্নাস। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন, যে যা পেরেছে তাই নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। শাসক হিসেবে শেখ হাসিনা ভয়াবহ একনায়কতন্ত্রের উদাহরণ হয়ে থাকবেন।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিন-তিনটি ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন করতে পেরে শেখ হাসিনা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন। স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতা ধরে রেখে আওয়ামী লীগ মূলত দেশে অপরাজনীতি ও যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। সেই যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা ছাড়া প্রায় সবাই আজ রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে একমত। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে চর দখলের মতো ভোটকেন্দ্র দখলের নির্বাচন- যা শেখ হাসিনাকে ক্রমে ক্রমে তৈরি করেছে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসক হিসেবে। দেশে এককথায় চালু হয়েছিল অনেকটা একদলীয় শাসন, যার চূড়ান্ত পরিণতি বিশ্বব্যাপী দেখেছে ৫ আগস্টে। জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা একটি বৈপস্নবিক পরিবর্তন। এটি ঘটেছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং তার সরকার কর্তৃক জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে।
রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার শুরু করার এখনই সুবর্ণ সময়। এ রকম সুযোগ ও সময় ইতিহাসে বারবার আসে না।
\হবলতেই হবে, আমরা এখন একটা সম্ভাবনার মধ্যে আছি। রাষ্ট্র সংস্কারের জরুরি বিষয়টি হলো ভবিষ্যতে এ ধরনের ফ্যাসিবাদী সরকারের উত্থানের পথরোধ করা। বর্তমানে রাষ্ট্রের যে সংস্কার প্রয়োজন এ বিষয়ে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের কারোরই দ্বিমত নেই। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ শাসকরা যাতে স্বৈরাচারী বা নির্বাচনী স্বৈরাচারীতে পরিণত না হন, তার জন্য রাষ্ট্রের কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। রাষ্ট্র সংস্কারের এখনই সময়। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে ভবিষ্যতে দানবীয় সরকারের উত্থানের পথ ঠেকানো সম্ভব হবে না। শুধু ফ্যাসিস্ট মাফিয়া শাসকদের সরানোর জন্য এত মানুষ জীবন দেয়নি। তারা জীবন দিয়েছে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য, যাতে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে আর কোনো শাসক এমন ফ্যাসিস্ট ও জুলুমবাজ হয়ে উঠতে না পারে।
৫ আগস্টের রক্তাক্ত বিপস্নবের পর দেশের সর্বস্তরের সচেতন নাগরিক শাসনের কাঠামো পরিবর্তনের পক্ষে মত দিচ্ছেন। আগামী দিনে সরকারগুলো যাতে দানবীয় শক্তিতে পরিণত না হয় এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠে আমরা সেটাই চাচ্ছি। ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ও বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করাই প্রথম কাজ বলে আমরা মনে করছি।
হাতে গোনা কয়েকজন পুঁজি পাচারকারী দেশ থেকে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এলেও, তাদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকার কিছুই করেনি। মোট ১৮ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের মধ্যে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র খেলাপি হলে আমরা কষ্ট হলেও মেনে নিতাম। কিন্তু আসল রহস্য হলো এর অধিকাংশই দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। অবশ্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা দাবি করেছে 'খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি।' পুঁজি-লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারীরা, ঋণখেলাপিদের 'জাতির এক নম্বর দুশমন' ঘোষণা দিয়ে 'বিশেষ ট্রাইবু্যনাল' গঠন করে আমরা বিচার দাবি করছি।
দুঃখজনকভাবে দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি 'দরবেশ' সালমান এফ রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বানিয়ে রাখা হয়েছিল। ৭টি ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ-লুণ্ঠনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন এফ রহমান। শুধু জনতা ব্যাংক থেকেই ঋণ নিয়েছেন ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তার মালিকানার আইএফআইসি ব্যাংক থেকে নাকি অবৈধভাবে ঋণ নিয়েছেন ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। টানা ২০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। মূলত ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া ও লুটপাটের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করার নীতির কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছিল।
মোহাম্মদ আবু নোমান : কলাম লেখক