আমাদের জাতীয় ফুল 'শাপলা', জাতীয় মাছ 'ইলিশ' জাতীয় পশু 'বাঘ' ও জাতীয় ফল 'কাঁঠাল'। দেশের জাতীয় অভিধাপ্রাপ্ত উলিস্নখিত বিষয়গুলো নিয়ে তেমন কারো কোনো উচ্চ-বাচ্য নেই, না থাকার কথাই। কারণ সবগুলো যথার্থ। হয়তো বলা যেতে পারে- এত কিছু বিষয় থাকতে এগুলো নিয়ে কেন ভাবছি। স্কুল ছাত্ররা গাড়িতে বসে একে অপরকে প্রশ্ন করছিল উলিস্নখিত বিষয়গুলো নিয়ে। একজন বলতে পেরেছে জাতীয় ফুল 'শাপলা', জাতীয় পশু 'বাঘ'।
এদের অন্যজন বলল, শাপলা ফুল দেখতে কেমন'রে ! অন্যরা উত্তর দিল একটা বই-এ দেখেছি, বাস্তবে দেখিনি। রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখতে পাই ডিসকাভারি চ্যানেলে। একমাত্র জাতীয় ফল কাঁঠাল দেখা যায় নির্দিষ্ট মৌসুমে। দুঃখ শুধু এক জায়গায়, অনেক ছাত্রছাত্রী জাতীয় অভিধাপ্রাপ্তগুলোর নাম জানে না। আবার জানলেও বাস্তবে দেখেনি। জাতীয় মাছ ইলিশ, একথা না জানলেও ইলিশ মাছ প্রায় সকলে চিনে। কাঁঠাল, শাপলা ও বাঘ চিনলেও জাতীয় বিষয়ে তারা জ্ঞাত নয়। কারণ এগুলো বিষয়ে তেমন আলোচনা হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকরা হয়ত কম আলোচনা করে। বিদ্যালয়ে আলোচনা করলে না দেখলেও জাতীয় নাম ধারণগুলো এদের স্মরণে থাকত।
শিশুরা পারিবারিক প্রাথমিক শিক্ষায় বাবা-মা বা শিশুর অভিভাবকরা কোমলমতি শিশুদের বইয়ের ছবি দেখিয়ে শেখায় জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পশু বাঘ ইত্যাদি। শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পর বাড়িতে আর ছেলেমেয়েদের উলিস্নখিত বিষয়ে পড়ানো হয় না। না পড়ানোর সুনির্দিষ্ট কারণ হতে পারে, বিদ্যালয়ে গাঁদা গাঁদা বইয়ের পড়া শিখাতে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও হাফিয়ে উঠছে বিদ্যালয়ের পাঠগুলো চুকাতে। অনেক পূর্বের কথা, তখনকার সময়ে এতগুলো বই ছিল না। ছিল নামতার বই, বাল্যশিক্ষা, বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালার বই।
শিক্ষানীতির পরিবর্তনে কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা নামতা মুখস্থ বলতে পারে না, শতকিয়া বলতে ভুল করে, বাংলা-ইংরেজিতে বর্ণমালা কয়টি বলতে পারে না। আরো উলেস্নখ্য যে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী জাতীয় সঙ্গীত মুখস্থ বলতে পারে না। এটির রচয়িতা কে তা-ও বলতে পারে না। আমরা এজন্য কাকে দায়ী করব? দায়ী বা কৈফিয়তের দিকে আমি যাচ্ছি না। যা সত্য তা হলো- এ দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। শিক্ষকদের মনমানসিকতার ওপর সবকিছু নির্ভরশীল।
এর পরেও কথা থেকে যায়, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতে সুপরিসর জায়গা দরকার। ভাড়া বাড়িতে জায়গা পাবে কোথায়? যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে তাদের দায়ী না করে অনুমোদন যারা দিচ্ছে তাদে দায়ী করা যেতে পারে। একটা বিদ্যালয়ে খেলার মাঠসহ আনুষঙ্গিক আরো কতগুলো বিষয় বাধ্যতামূলক। অনুমোদন দেওয়ার পূর্বে দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিশ্চয়ই ওই অনুমোদন প্রার্থনাকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে যায়। তারা সবকিছু দেখেশোনে তবেত অনুমোদন দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনুমোদনকারী দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রধানকে 'ম্যানেজ' করে অনেকে অনুমোদন নিচ্ছে। একথার কতটুকু ভিত্তি আছে আমি জানি না। অন্ধ চায় চোখ, ক্ষুধার্তরা চায় খানা, তেমনি আমরাও চাই, আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হোক।
সুপ্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আমি লেখার মূলে ফিরে আসছি। প্রসঙ্গ উলেস্নখ করতে গিয়ে লেখার বিস্তৃতি ঘটে গেল। জাতীয় মাছ 'ইলিশে' ফিরে আসছি। ইলিশ মাছ সবার প্রিয় এবং লোভনীয় খাদ্য। ইলিশ মাছের পাতরির কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পয়েলা বৈশাখে পান্তাভাতে ইলিশ- বাঙালি জাতির ঐতিহ্য। ইলিশ মাছকে যেভাবে খেতে ইচ্ছে হয় খাওয়া যায়। স্বাদের তারতম্য থাকলেও নানা আঙ্গিকে ইলিশ মাছ খেতে পারছি না আমরা। ইলিশ মাছ বর্তমানে সোনার হরিণের মতো। নানা প্রচার মাধ্যমে মাছের মূল্যবিষয়ে যে তথ্য জানা যায়, বাস্তবে বাজারমূল্যের সঙ্গে কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির মানুষের কাছে যেন কিছুই না। বাজারে বিক্রেতা বলল, প্রতি কেজি ইলিশ একদাম বারোশ' টাকা, মুলামুলি নেই। দাম শোনেই আমার ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছে পানসে হয়ে গেল। পরক্ষণে ভাবছি বাড়িতে গিয়ে গিন্নিকে কি জবাব দেব। বাজার থেকে ইলিশ মাছ আনব বলে পুত্র-কন্যাকেও কথা দিয়ে এসেছি। নানা চিন্তার বেড়াজালে আটকে আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এক ক্রেতা এসে বিক্রতাকে বলল, দেখে দেখে দশ-বারোটা ইলিশ ওজন করো। বিক্রেতা দুই পালস্নায় চৌদ্দটা ইলিশ ওজন করল। ক্রেতা বললো, কত টাকা হলো। বিক্রেতা মূল্য বলার সঙ্গে সঙ্গেই ক্রেতা পকেট থেকে কসকসে এক হাজার টাকার নোট বের করে মূল্য চুকিয়ে দিয়ে বিক্রতাকে বলল, মাছগুলো আমার গাড়িতে তুলে দিয়ে এসো। আমিও শেষমেশ আটশ' গ্রামের একটা মাছ নিলাম বাজার অনেক কাটছাঁট করে।
বাংলাদেশে ইলিশ মাছের কদর আগে যেমন ছিল, বর্তমানেও তাই আছে। পারিবারিক নানা আয়োজনে বিত্তশালীরা খানার ম্যানুতে ইলিশ মাছ রাখে। খানা পরিবেশনের সময় জোর গলায় ইলিশ আইটেমের কথা বলে। অপ্রিয় সত্যকথা হলো- গরিবরাও কিন্তু রসনাবিলাসের এ ইলিশ রাখে খানার আয়োজনে। আজকাল লোকরা এ বিষয়ে তেমন ভাবে না।
ইলিশ স্বাদু পানির মাছ। কিন্তু অধিক দামের কারণে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ইলিশ মাছ কমে যাওয়ার অনেকে নানা মত দিলেও মূলত আবহাওয়া পরিবর্তনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভরা মৌসুমেও সাগরে ইলিশ মাছ মহার্ঘ। এ তথ্য জানালো সাগর থেকে বিফলমনোরথে ফিরে আসা জেলেরা। আগে মইলিশ মাছের প্রচুর সরবরাহ দেখেছি, দামও ছিল নাগালের মধ্যে। ক্রেতার আকর্ষণ তেমন ছিল না। বিক্রেতারা ইলিশ মাছ বিক্রি করতে না পেরে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যেত আছদগঞ্জের শুঁটকি পট্টিতে। সেখানকার দোকানদাররা মাছগুলো খামাল দিত লবণসমেত। যা পরবর্তী সময়ে ইলিশ মাছ 'নুনিয়া' ইলিশে রূপান্তরিত হতো। এখনো সেই নিয়ম চালু থাকলেও নুনিয়া ইলিশ তৈরির প্রক্রিয়া অনেকটা পাল্টে গেছে। আছদগঞ্জে আগের মতো নুনিয়া ইলিশ মাছ তৈরির প্রক্রিয়া তেমন দেখা যায় না, ব্যক্তিগতভাবে অনেকে এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের নিচে, আশপাশের ফুটপাতে নুনিয়া ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
নুনিয়া ইলিশের স্বাদ লিখে বা বলে বুঝানো যাবে না। যারা একবার নুনিয়া ইলিশ খেয়েছে তারাই বলতে পারবে মজা কাকে বলে। বর্তমানে সবকিছু যেন ধীরগতিতে ইতিহাস তথা স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিতে যাচ্ছে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ।
ইলিশ তিন ইঞ্চি লম্বা হওয়ার পর সাগরে চলে যায় এবং সেখানেই বৃদ্ধি ঘটে। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ পদ্মা ও মেঘনার স্রোতের বিপরীত দিকে যেতে থাকে। এই সময়েই ইলিশ পূর্ণতা পায়। কিন্তু জেলেরা অতি লাভের আশায় ইলিশকে বড় হওয়ার সুযোগ দেয় না, জালে আটকিয়ে ফেলে। যাকে আমরা জাটকা বলে অভিহিত করি। ইলিশ ধরার আইন দেশে আছে। কিন্তু আইন কেউ মানতে চায় না। নির্বিচারে ইলিশ ধরা হচ্ছে। এখবর আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়।
জাতীয় ইলিশ মাছ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে।
\হযেই পদ্মার ইলিশের জন্য ভারতীয় বাঙালিদের চোখের জল আর জিভের পানি এক হয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা কিন্তু বাংলাদেশিদেরও। ফারাক্কা নদীর কারণে পদ্মার পানি কমে যাচ্ছে। গভীর পানি নেইতো ইলিশও নেই। এই পরিস্থিতিতে করণীয় রয়েছে অনেক কিছু- যা নীতিনির্ধারকরা ভালো বলতে পারবেন। এ বাংলার সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা না ভেবে বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবলে সমাধান হয়ত একটা বেরিয়ে আসবে।
ইলিশের আকালরোধে এখনই ভাবতে হবে। পদ্মায় যাতে পানি কমে না যায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের। ইলিশ মাছ বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের একটা অংশ। ঐতিহ্য রক্ষায় ত্যাগ স্বীকারের কোনো বিকল্প নেই। আবার অনেকে বলছেন, হয়ত-বা ইলিশের সুদিন আসবে।
আমিও সবার সঙ্গে একমত পোষণ করছি।
শতদল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক