রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

প্রাথমিক শিক্ষায় যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন

কয়েকদিনে অর্ধশত বছরের আবর্জনা উপড়ে ফেলা সম্ভব নয় কিন্তু উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষাকে।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
প্রাথমিক শিক্ষায় যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন

শিক্ষার ভিত প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষার এই স্তরে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সম্পর্ক থাকে নিবিড়। শিশুদের জন্য তার মা-বাবার সান্নিধ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন শিশুদের জন্য তার শিক্ষকের স্ব-শরীরে কাছাকাছি থাকাও গুরুত্ব বহন করে।

প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নত অবকাঠামো, উন্নত পাঠ্যপুস্তক অনুকূল পরিবেশ সবকিছুই দরকার কিন্তু কোনো কারণে যদি এর একটাও না থাকে তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। শুধু উন্নত, দক্ষ, নৈতিক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী থাকলেই শিশুদের পাঠদান সম্ভব।

যদি সবকিছু থাকে কিন্তু শিক্ষক দক্ষ, আন্তরিক, নৈতিক গুণসম্পন্ন না হয় তাহলে সবকিছুই বৃথা।

অবকাঠামো, পাঠ্যপুস্তক, অনুকূল পরিবেশ সবকিছু ছাড়াও শিক্ষক তার দক্ষতা, মেধা দিয়ে গড়ে তুলতে পারেন শিক্ষার্থীদের।

সুতরাং, প্রাথমিক শিক্ষার মূল উপাদান শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী।

সেই আদিকাল থেকে শুনে আসছি, 'শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড'। অথচ এই শিক্ষার দায়িত্ব যে শিক্ষাগুরুর তিনি সর্বদা অবহেলিত, উপেক্ষিত।

শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষকের জীবনমান, মর্যাদার দিকে মনোযোগী না হয়ে রাষ্ট্র বারবার শিক্ষকদের পাহারা দিতে তৈরি করেছে নানা ধরনের পাহারাদারের পদ। শিক্ষককে শিক্ষাগুরু তৈরিতে কখনোই মনোযোগী হয়নি রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

গুরু দ্রোণাচার্য তার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৈরি করেছিলেন অর্জুনকে। তিনি যেমন অর্জুনের গুরু ছিলেন তেমন দুর্যোধনেরও গুরু ছিলেন কিন্তু গুরু দ্রোনাচার্যের জন্য বিজয় এবং সম্মান এনে দিয়েছিল অর্জুন।

একজন শিক্ষক বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকেন শান্ত, নিরীহ। তার থাকে স্বপ্ন। কুমার যেমন কাদামাটি দিয়ে মনের মাধুরী মিশায় তৈরি করেন শিল্প তেমনি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকের সামনে থাকে একতাল মাটির মতো কোমল শিশুরা। শিশুদের চোখে আলো আর মুখে ভাষা দেওয়ার কর্মযজ্ঞে শিক্ষক ব্যয় করেন তার গোটা জীবন।

শিক্ষক সমাজের দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেন না কিন্তু স্বপ্ন দেখেন তারই সৃষ্টি একদিন এই অন্যায়গুলো সমাজ থেকে মুছে দেবে। শিক্ষক সমাজ বদলে দিতে পারে না কিন্তু তারই সৃষ্টি বদলে দেবে বৈরীর সময় এবং সমাজকে সে স্বপ্ন তিনি লালন করেন নীরবে নিভৃতে।

আমরা সৈয়দ মুজতবা আলীর 'পাদটিকা' গল্পের পন্ডিতমশাইয়ের গাণিতিক সমস্যা শুনে যুগে যুগে স্তম্ভিত হয়েছি।

সেই গাণিতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি কেউ।

কবিতার বিখ্যাত চরিত্র তালেব মাস্টার। তালেব মাস্টারের ছাত্ররা ব্যারিস্টার হয় কিন্তু তার ছেলে মরে বিনা চিকিৎসায়। তালেব মাস্টারের মেয়ে অনাহারে আত্মঘাতী হয়।

আমরা শিক্ষকদের অসহায়ত্ব দেখতে পছন্দ করি।

নজরুলের আগ্নেয়গিরির আচমকা কেউ ঘুরে দাঁড়ালে কী হবে সেটা ভেবে দেখিনি।

শিশুরা একতাল কাদামাটির মতো। শিক্ষক তাকে শৈশবে যে আদর্শে গড়ে তোলেন তা পরবর্তী সময়ে তার হৃদয়ে থেকে যায়। নৈতিকতার প্রথম ধাপে যেমন শিক্ষক শিশুরা পায় পরবর্তী সময়ে তেমন মনোভাব গঠনে তা ভূমিকা রাখে।

আমরা বহুকাল যাবত মানসিকভাবে ধরেই নিয়েছি আমাদের অবকাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পরিবর্তন আসবে না শিক্ষার ক্ষেত্রে। ফলে, যা কিছু বৈষম্য, যা কিছু অন্যায় তা নিয়তি মনে করে নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম নিয়তির কাছে।

আচমকা সবকিছু ওলট-পালট করে জেগে উঠলো আমাদের শান্ত, রাজনীতি বিমুখ সন্তানরা। তারা আমাদের স্বপ্নহীন চোখে আবার স্বপ্ন এঁকে দিল। হতাশায় পূর্ণ হৃদয়ে আশার আলো জাগাল। নতুন এক সমাজ নির্মাণ, নতুন এক ভোরের বাসনায় আমরা আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

যা কিছু অপমান, অসম্মান তার অবসানের জন্য যা কিছু অনিয়ম তার পরিবর্তনের জন্য আবার বলা শুরু করলাম।

এবার শাসক পরিবর্তন নয়, গোটা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

শিক্ষকতা জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে যে সংস্কার প্রয়োজন আমি মনে করি তা হলো:

১/ শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান।

২/ রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত নৈতিক শিক্ষক তৈরি।

৩/ মেধা এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে নিয়োগ।

৪/ কর্মকর্তাদের হয়রানি ভিজিট বন্ধ করা।

৫/প্রধান শিক্ষককে আর্থিক ব্যাপারে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রদান করা।

৬/ প্রধান শিক্ষকের চেয়ার বরাদ্দ থাকবে শুধুই তার জন্য। দেশের প্রধানমন্ত্রীও সে চেয়ারে বসতে পারবেন না।

৭/ শিক্ষা অফিসের দুর্নীতি, ঘুষ বন্ধ করা।

৮/ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব হবে সহযোগিতা করা। ছড়ি ঘুরানো নয়।

৯/ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতার বিষয়ে অনার্স চালু করতে হবে। যিনি শিক্ষক হবেন তিনি এই বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স করেই আসবেন।

১০/ দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের এই পেশায় আগ্রহী করার জন্য উন্নত জীবনমান, ঈর্ষণীয় বেতন এবং বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে প্রাথমিক শিক্ষকদের পেশাকে।

\হ১১/ শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত নানা কাজের জন্য একটি উন্নত সার্ভার তৈরি করতে হবে।

১২/উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার আলোকে নিজের দেশের উপযোগী একটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য যোগ্য, দক্ষদের নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সিদ্ধান্তে প্রাথমিকের যোগ্য শিক্ষকদের মতামত শুনতে হবে।

১৩/ যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কথা বলার স্বাধীনতা শিক্ষককে দিতে হবে।

১৪/ বছরের পর বছর বিদ্যালয়ে না এসেও কারা বেতন নিচ্ছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করে দ্রম্নত ব্যবস্থা নিতে হবে। এদের কারা সহযোগিতা করেছে সেটাও খুঁজে বের করতে হবে।

১৫/ শিশুদের জন্য গল্প, কবিতা, ছড়ার বই রচনায় এবং নির্ধারণে প্রাথমিক শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

১৬/যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিটি জেলায় পদোন্নতি দিতে হবে।

১৭/সম্মান যেমন অন্যদের চেয়ে বেশি হবে তেমন অন্যায়ের শাস্তিও হবে অন্যদের চেয়ে বেশি।

১৮/প্রতিটি বিদ্যালয়ে অফিসিয়াল কাজের জন্য একজন অফিস সহকারী নিয়োগ দিতে হবে।

\হ১৯/ আপ্যায়নের নামে দামি উপহার এবং রাজকীয় ভোজ এড়াতে হবে।

২০/ রাজনৈতিক কাজে শিক্ষকদের ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।

২১/ শিক্ষক, শিক্ষার্থী অনুপাত হবে ১:২০।

২২/ বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনতে হবে।

২৩/ শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।

২৪/ একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩টা ক্লাস নেবেন।

২৫/ পাঠদানে শিক্ষকের স্বাধীনতা দিতে হবে।

২৬/ প্রতিদিনের পাঠ শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার ভিত্তিতে নির্বাচন করবেন।

২৭/ বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে কর্মকর্তা বা প্রধান অতিথির জন্য নির্ধারিত সময়ের পর শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করার নিয়ম বাদ দিতে হবে।

২৮/ প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন কাউন্সিলিং শিক্ষক থাকবেন। যার কাছে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক নির্ভয়ে সব সমস্যা তুলে ধরতে পারবেন।

২৯/ শিক্ষকের কাজের মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা থাকতে হবে।

৩০/ শিক্ষকের নিজের, স্ত্রীর বা অন্য কোনো আত্মীয়ের নামে কিন্টার গার্ডেন, মাদ্রাসা বা কোচিং সেন্টার থাকতে পারবে না।

৩১/ সামাজিক কাজে শিক্ষকের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রেখে ছোট থেকেই সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা শিখবে।

৩২/ শিক্ষকদের অবসরকালীন পেনশন ঘুষবিহীন, সহজ এবং দ্রম্নত করতে হবে।

৩৩/ সততা, সত্যবাদিতা, সম্মান করা এসবের অনুশীলন শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষকের জীবনাচারণ দেখে শিখবে।

কয়েকদিনে অর্ধশত বছরের আবর্জনা উপড়ে ফেলা সম্ভব নয় কিন্তু উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষাকে।

আদর্শ, নৈতিক, দক্ষ জাতি গঠনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষকদের অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রাথমিক শিক্ষক এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে তালিকায় এক নম্বরে রেখে পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে