সিদ্ধান্ত গ্রহণ এমন একটি প্রক্রিয়া- যার মাধ্যমে কোনো সমস্যা সমাধানের সঠিক ও সর্বোত্তম উপায় নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্তকে নির্ভরযোগ্য করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্যের প্রয়োজন হয়। তথ্য ও উপাত্তের বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয়, তবে যে ধরনের তথ্যই হোক সেটা হতে হবে নির্ভুল, নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবসম্মত।
কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান তথ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ করা হচ্ছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও দেশে আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অর্থনীতির মূল সূচকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল। ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। তখন অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বানোয়াটভাবে দেখানোর অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও পরিসংখ্যানগত পার্থক্য বাড়তে থাকে। এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময়ে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই কেবল সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল। এসব বানোয়াট তথ্য প্রদানের প্রধান কারিগর হিসেবে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামাল ওরফে মুস্তফা কামালকে মনে করা হয়। তিনি পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিলেন- যা বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, বৈশ্বিক ইতিহাসেও বিরল ও অভূতপূর্ব!
সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে বিশদ প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, লোটাস কামাল একজন পেশাদার হিসাববিদ, হিসাবশাস্ত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং আইন শাস্ত্রেও তার স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে। তিনি শিক্ষা জীবনে মেধার স্বীকৃতি হিসেবে 'লোটাস বা পদ্ম' উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ লব্দ জ্ঞানকে ভালো কাজে ব্যবহার না করে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছিলেন। পলাতক শেখ হাসিনা সরকার ২০১৮ সালের রাতের ভোটের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতায় বসে মিথ্যা তথ্যের পুরস্কার স্বরূপ তাকে পরিকল্পনামন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। অভিযোগ রয়েছে তিনি তার দপ্তরে নিয়মিত গরহাজির থাকতেন এবং ঘরে বসে অফিস করতেন। তিনি তার কাজে বেশ অমনোযোগী ছিলেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের তথ্য পরিসংখ্যান- যা পরিচালিত হতো রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে এবং এটি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। ফলে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে ধারাবাহিকভাবে বানোয়াট প্রবৃদ্ধি দেখানো হতো। কিন্তু সামষ্টিক তথ্যের সঙ্গে যার কোনো মিল ছিল না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে বিকৃত ও বানোয়াট পরিসংখ্যান সরবরাহ করা হয়। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণের কারণেই দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে এসব শুভঙ্করের ফাঁকি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
জানা যায়, বিশ্বব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে থাকে। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের স্কোর ছিল একশ'র মধ্যে ৮০। কিন্তু এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সে স্কোর দ্রম্নত হ্রাস পেয়ে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় বাংলাদেশ মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে এবং এক্ষেত্রে বিকৃতি ও বানোয়াট পরিসংখ্যান তথ্য তৈরি ও সরবরাহের কারণে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।
পত্রিকাটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) দেশের সব ধরনের সরকারি পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশ করে থাকে। লোটাস কামাল এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরই বিবিএসকে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ সময় সংস্থাটির মাধ্যমে নিয়মিত মাসিক মূল্যস্ফীতি প্রকাশের দায়িত্বটিও নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। পরবর্তী সময়ে বিবিএসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিপিআই শাখার জনবলেও পরিবর্তন আনা হয়। পদায়ন করা হয় তার অনুগত ও আশীর্বাদপ্রাপ্তদের। বিবিএসের বর্তমান ও সাবেক পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটিতে কথা বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ নূ্যনতম আপত্তি তুললে বা কথা বলার চেষ্টা করলে ঢাকার বাইরে বা কম গুরুত্বপূর্ণ শাখায় বদলি করে দেওয়া হতো। এমনকি বিনা কারণে হয়রানির জন্য বিভাগীয় মামলাও করা হয়।
তৎকালীন বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যগত পার্থক্য বেড়েই চলছিল। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান লোটাস কামাল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও লোটাস কামাল ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে ভৌতিক দাবি করেন। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এডিবির পক্ষ থেকেও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়। এতে তখন লোটাস কামাল ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করে সংবাদ সম্মেলনও করেন।
আসলে দেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়ানুগ পরিসংখ্যানের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব খাতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আরও বাড়বে। সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী পরিসংখ্যান টেকসই উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের পরিবর্তিত বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। পরিসংখ্যানের গুরুত্ব স্থান ও কাল ভেদে সব সময়ই ছিল। কিন্তু এখন আরও অনেক বেড়েছে। কারণ দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি বুঝতে হলে পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। তাছাড়া, জাতির উন্নয়ন আর অগ্রগতি যা-ই বলেন, সবকিছুর সঙ্গেই পরিসংখ্যান তথ্য জড়িত। মানুষের সুষম উন্নয়নের জন্যও পরিকল্পনার প্রয়োজন। এখন বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানের দিক বিবেচনা করেই উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
পরিসংখ্যানবিদদের মতে, সব খাতে নির্ভুল পরিসংখ্যানের তথ্য প্রয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়। পরিসংখ্যান উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিমাপক। আর্থসামাজিক সব কর্মকান্ডের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত সঠিক পরিসংখ্যানই কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বশর্ত। অর্থনৈতিক, জনমিতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে পরিমাণগত ও গুণগত পরিমাপে পরিসংখ্যানের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সঠিক ও সময়োচিত পরিসংখ্যানের ব্যবহার অপরিহার্য।
বাস্তবতার নিরিখে বর্তমান বিশ্বে পরিসংখ্যান এমন একটি স্বীকৃত বিজ্ঞান, যার ওপর ভিত্তি করে দেশ, জাতি, করপোরেট বিশ্বের যত সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। পরিসংখ্যানহীন যে কোনো তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণ এমনকি সিদ্ধান্তও এখন একেবারেই অচল। তথ্য উপাত্তের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে আধুনিক কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য ও নানা অঙ্গনে। দেশের বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান নিয়ে পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ জিয়া হাসান ২০২২ সালে '?উন্নয়ন বিভ্রম এক দশকের অর্থনীতির না বলা ইতিহাস' শীর্ষক বই লেখেন। প্রবাসী এ লেখক সাড়া জাগানো বইটিতে পদ্ধতিগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে সরকারি পরিসংখ্যানের অসারতা তুলে ধরেন। পরিসংখ্যানগত কারসাজি নিয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, 'দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকেই ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে যাওয়ার একটি প্রবণতা ছিল। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের পরিসংখ্যান। তাই সুনিপুণভাবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও ম্যাক্রোর ডাটার সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না। প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা। কিন্তু শিল্প প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল কৃষিতে। আবার কর্মসংস্থান না বাড়লে, শিল্প ব্যাপক মেকানাইজেশন হওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও আমরা সেভাবে দেখিনি।'
তথ্য বিকৃতির পরিণাম সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোর মতো ঘটনা কিংবা অন্ধের হাতি দর্শন। তথ্য বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ধারণা দেয়।
\হকিসের ভিত্তিতে দেশ চলবে, এটা বলে দেয় পরিসংখ্যান। কিন্তু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করলে দেশকে কোথাও না কোথাও ধাক্কা খেতে হবে। যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া রাজস্ব ও রপ্তানিসহ সব পরিসংখ্যানের মধ্যেই দূষণ ধরা পড়ছে। বিগত পতিত স্বৈরাচারী হাসিনার সরকার পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে যে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিলেন- যা বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, বৈশ্বিক ইতিহাসেও বিরল ও অভূতপূর্ব! ভবিষ্যতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।
মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক