মার্কিন নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের চ্যালেঞ্জ

কমলা হ্যারিস আমেরিকান রাজনীতির সবচেয়ে বড় মঞ্চে তার টিকিট 'পাঞ্চ' করেছেন। এখন তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য উপযুক্ত।

প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ দেশে জাতীয় নির্বাচন। মার্কিন এই নির্বাচনকে ঘিরে নজর থাকে প্রতিটি দেশের। এই ধারা থেকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণও পিছিয়ে নেই। তারাও মার্কিন নির্বাচনকে ঘিরে কী হচ্ছে তার প্রতি নজর রাখছে। অনেক আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন জো বাইডেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের মনোনয়নের পথ প্রশস্ত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোই তার উত্তরসূরি হয়েছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য তার লড়াই হবে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে বাইডেন জানান, তিনি নতুন প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান। আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে এটাই সেরা উপায় বলেও দাবি করেন। বাইডেন বলেন, 'আমি ঠিক করেছি যে, নতুন প্রজন্মের হাতে আগামীর মশাল তুলে দেব। এটাই যুক্তরাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করার সেরা উপায়।' তিনি আরও বলেন, 'আমি আমার কাজকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি আমার দেশকে। আপনাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে পেরেছি, এটা আমার জীবনে সৌভাগ্যের বিষয়।' তিনি জানান, বিপদে থাকা গণতন্ত্রকে রক্ষা করা যে কোনো খেতাবের চেয়ে বেশি জরুরি। রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী তথা সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিভিশনে বিতর্কে বাইডেনের কথার খেই হারানো, মৃদু স্বরে বক্তব্য রাখা নিয়ে ডেমোক্র্যাট শিবিরে আলোচনা শুরু হয়। প্রথমে ফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে দাঁড়ানোর বিষয়ে প্রত্যয় দেখালেও শেষে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানান বাইডেন। তিনি আরও বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার কাজ, দেশে এবং বিদেশে আমার নানা নীতি এবং আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য আমার ভাবনা- সবকিছুই দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু গণতন্ত্র বাঁচানোর যাত্রায় এ সবকিছু আগে আসতে পারে না।' \হতাই, কমলা হ্যারিসের সামনে প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো নভেম্বরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করা। কিছু দিন আগের কথা, জো বাইডেন যখন নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান। কমলা হ্যারিস যখন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনীত হয় তখন এক জনমত জরিপে দেখাগিয়েছিল, কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছেন। ঠিক যে অবস্থানে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন গত ট্রার্মে তার নির্বাচনের সময়ে। কিন্তু অতি সম্প্রতি একজন জরিপে দেখা গেছে সেই কমলাই এখন ট্রাম্প থেকে কিছুটা এগিয়ে আছেন। আসলে নিজের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার পর কমলা হ্যারিসের নাম উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তাব করেছেন জো বাইডেন- এই বিষয়টা ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে নতুন শক্তি জুগিয়েছে। নভেম্বর মাসের মার্কিন নির্বাচনে একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা যাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের কাছে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি গত নির্বাচনের পূর্বে জনগণের যে বিদ্বেষ ছিল তা পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা, মধ্যপন্থি ভোটারদের আকৃষ্ট করা এবং তার দলকে রি-অর্গানাইজড করে শক্তিশালী করে তোলা। তার দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, যে অঙ্গরাজ্যগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা তার অনুকূলে আনা। তার তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, গতবার যে অঙ্গরাজ্যগুলোতে তার দল খুব কম ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল তার নতুন-পুরাতন ভোটারকে অনুকূলে আনা। এত সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কমলা হ্যারিসের জন্য সুখের খবর হলো, বিবিসি সূত্রে জানা গেছে যে, তার প্রচার শিবিরের তথ্য অনুযায়ী, জো বাইডেনের প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভাইস প্রেসিডেন্ট নতুন অনুদান হিসেবে ৮ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছেন, যা এবারের নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর একদিনে সংগ্রহ করা অনুদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর পাশাপাশি, বাইডেন-হ্যারিসের তহবিল থেকে 'উত্তরাধিকার সূত্রে' পাওয়া প্রায় ১০ কোটি ডলার মিজ হ্যারিসকে তার আসন্ন নির্বাচনী প্রচারের জন্য একটা মজবুত আর্থিক ভিত্তি দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রচারের সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন 'দুর্বল' এবং 'সহজেই বিভ্রান্ত' হয়ে পড়েন এমন অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট যদি আনুষ্ঠানিকভাবে তার দলের মনোনয়ন পান, তাহলে এই নির্বাচনে রিপাবলিকানরা তাদের প্রতিপক্ষ 'ডেমোক্র্যাটদের' বিরুদ্ধে যে কার্যকর আক্রমণ চালিয়ে এসেছিল তার একটা মোক্ষম উত্তরও দিতে পারবেন এবং সেটা হলো প্রার্থীর বয়স। শুধু তাই নয়, এই বয়সের বিষয়টাকেই তিনি চাইলে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন মি. ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। ট্রাম্পের বয়স এখন ৭৮। জিতলে ৭৮ বছরের এই রিপাবলিকান প্রার্থীই হবেন এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বয়স্ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাছাড়া, কমলা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের কাছ থেকে সমর্থন পেতে সক্ষম হতে পারেন- যারা সাম্প্রতিক মাসগুলিতে মি. বাইডেনের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন বলে জনমত জরিপে উঠে এসেছিল। তিনি যদি অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেন তাহলে তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শক্ত জমি পেতে কমলা হ্যারিসকে সাহায্য করতে পারে। এত সব সুবিধার মধ্যে কমলা হ্যারিসের আরও কিছু চ্যালেঞ্জ বা অসুবিধা হলো আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি যে, তার প্রসিকিউশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। যা ২০১৯ সালের ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের সময় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বামপন্থিদের কাছ থেকে আক্রমণের মুখেও ফেলেছিল তাকে। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বামপন্থিদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছিল 'কমলা একজন পুলিশ'। পক্ষান্তরে চান্স বা সুবিধা হলো, ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস কিন্তু গর্ভপাতের সমর্থনে কথা বলেছেন- যা সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটের পক্ষে ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রটাকে তাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য যে, ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তার দলের মধ্যে তিনি লড়েছিলেন। তবে সেবার তার লড়াই সফল হয়নি। ডেমোক্র্যাটিক মনোনয়নের প্রার্থী হিসেবে তিনি দ্রম্নত সামনের সারিতে চলে এলেও তার 'অসংযত বাক্যালাপ, যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং উপযুক্ত প্রচারাভিযানের ফলে প্রাথমিক প্রতিযোগিতার আগেই বাদ যেতে হয়েছিল কমলা হ্যারিসকে। আরও একটি বিষয় তার জন্য অস্বস্তির, তাহলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কখনো কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট পদে জিততে পারেনি। তিনি যদি জিততে পারেন তা হলে মার্কিন মুলস্নুকে একজন মহিলা হিসেবে তিনি ইতিহাস গড়বেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসেবে আমেরিকানদের কাছে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে তার হাতে। কমলা হ্যারিস আমেরিকান রাজনীতির সবচেয়ে বড় মঞ্চে তার টিকিট 'পাঞ্চ' করেছেন। এখন তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য উপযুক্ত। মো. মাঈন উদ্দিন : কলাম লেখক