উপাচার্য নিয়োগে দলীয়করণ রোধে টেকসই সমাধান কী?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক অধ্যাপকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এবং শিক্ষক হিসেবে জ্যেষ্ঠতম হয়েও শুধু রাজনৈতিক আশীর্বাদ না থাকার কারণে উপাচার্য হতে পারেন না।
প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী
ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের ফলে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দেশে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারের পতনের পর পর্যায়ক্রমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা শুরু করেন। অতীতে এমনও ঘটেছে যে, দলীয় সরকারের পতনের পর রাতেই উপাচার্য তার বাসভবন ছেড়ে গেছেন। বিষয়টি উপাচার্যের জন্য তো বটেই দেশের সব শিক্ষক সমাজের জন্য অসম্মানজনক ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ কতটা খারাপ হলে এরূপ ঘটনা ঘটে তা সহজেই অনুমেয়। সরকার আসবে বা সরকার যাবে এটাই একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু কেন এরূপ ঘটনা ঘটবে?
এখন পর্যন্ত দেশের ৫৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০টির অধিক বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকশূন্য। উপাচার্যরা তাদের পদত্যাগের মূল কারণ দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত সমস্যা। কিন্তু মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। উপাচার্যরা এটা বুঝেছিলেন যে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে উপাচার্যরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন না অথবা অতীতের মতো সরকারের পরিবর্তনের পর অন্তর্র্বর্তী সরকার তাদের সরিয়ে দেবেন- যা অসম্মানজনক। যেহেতু গণ-অভু্যত্থানের মূল নেতৃত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা আর গণহত্যার জন্য যে দলটি দায়ী সেই দলের এতদিন আনুগত্য করেছেন। তাই উপাচার্যরা নিতান্তই সম্মানের ভয়ে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু যারা পদত্যাগ না করে উপাচার্য পদটি ধরে রাখার শেষ চেষ্টা করেছেন তাদের হয়ত বিশেষ কোনো কারণ আছে। অনেক উপাচার্য ক্ষমতায় থাকাকালে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করেছেন, বৈষম্য করেছেন তারা এ সময়ের মধ্যে দ্রম্নততার সঙ্গে সব সমস্যা সমাধানেরও চেষ্টা করেছেন। কারণ তারা জানেন, সমস্যাগুলো সমাধান না করে পদত্যাগ করলে তারা অনেক অসম্মানিত হবেন। এই ভয়ে পদত্যাগের জন্য কিছুটা সময় নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, মাই রেসপেক্ট কামস ফার্স্ট। এ রকম উপাচার্যই প্রয়োজন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। রাজনৈতিক মনোনয়নে উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়ে নীতি-নৈতিকতা দেখানো অনেক কঠিন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পক্ষের আস্থা থাকলেও স্থানীয় এলাকার জনগণকে আস্থায় নেওয়া কঠিন হবে আর সে কারণেই তারা পদত্যাগ করেছেন।
উপাচার্যদের গণহারে পদত্যাগ নৈতিকতার কারণের পাশাপাশি একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে তা ভবিষ্যতে বিশ্লেষণ হতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম গণহারে পদত্যাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের। পৃথিবীর কোনো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের গণহারে পদত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন। অন্য দেশগুলোতেও সরকারের পরিবর্তন হয়, এক দলের পরিবর্তে অন্য দল রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসে। জনপ্রশাসনে সামান্য পরিবর্তন এলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপাচার্যসহ অন্য পদে পরিবর্তন হয় না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়কে সব ধরনের রাজনীতির বাইরে রাখা হয়।
আমাদের শিক্ষার্থীরা ও দেশের মানুষ এটা আর দেখতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ পেশাজীবী তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। শতভাগ কর্মসংস্থানভিত্তিক বিষয় চালু করে বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারছে তা প্রশ্নের মুখোমুখি। প্রকৌশল, কৃষি, মেডিকেল ও অন্যান্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে।
উপাচার্য পদের জন্য অধ্যাপকরা কেন এত প্রতিযোগিতা করেন ও দলীয় রাজনীতির অংশ হন? কারণ ক্ষমতা, সামাজিক পদমর্যাদা ও অতিরিক্ত সুবিধা যেমন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি, অফিস ও পরিবারের জন্য সার্বক্ষণিক ২টি গাড়ি, আপ্যায়ন ভাতা, ধোলাই ভাতা, গৃহকর্মীর বেতন, সব নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি, সব ক্রয়কার্যের হেড অব প্রকিরউমেন্ট এনটিটি, শিক্ষার্থীদের প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সম্মানি, বিভিন্ন সভার সম্মানি, ভর্তি পরীক্ষার সভাপতি হিসেবে সম্মানি, বড় বড় আর্থিক প্রকল্পের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকারীসহ বাড়তি অনেক আর্থিক সুবিধা। আর এজন্যই উপাচার্য পদের জন্য ২ কোটি টাকার ঘুষ প্রদান করার অনিয়ম ওঠে আসে পত্র-পত্রিকায়। এত সুবিধা ও ক্ষমতা একজন উপাচার্যকে শুধু দাম্ভিকতাই করে না সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরাচারীই করে। উপাচার্যরা তাদের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের নিজেদের শক্তি মনে না করে, তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহযোগিতার ওপর ভর করেন। তিনি ভুলে যেতে থাকেন যে, তিনি একজন শিক্ষক আর হয়ে উঠেন একজন প্রশাসক। উপাচার্য পদে এতটা সুবিধা দেওয়া কেন প্রয়োজন? সব বাড়তি সুবিধা একত্রিত করলে তার আর্থিক মূল্য হয়ত এক-দুইজন অধ্যাপকের মাসিক বেতনের সমান হবে। এ ধরনের অতিরিক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে উপাচার্যদের সাধারণ অধ্যাপকের কাতারে আনা উচিত। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষ্যমের জন্য উপাচার্যদের দায় সবচেয়ে বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক অধ্যাপকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এবং শিক্ষক হিসেবে জ্যেষ্ঠতম হয়েও শুধু রাজনৈতিক আশীর্বাদ না থাকার কারণে উপাচার্য হতে পারেন না।
এটা দেশে বিদ্যমান উভয় দলের শিক্ষক নেতাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রধান কাজ হলো উন্নয়ন, মূল্যায়ন, তত্ত্বাবধান, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজের সঠিক ব্যবস্থাপনা। উন্নয়ন বলতে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, গবেষণার জন্য সহায়ক সব ব্যবস্থার উন্নয়ন, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারিকুলাম তৈরি ও ক্রমাগতভাবে তা উন্নয়ন করা, টিচিং-লার্নিং পদ্ধতির উন্নয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারির বিষয়ে মানোনিবেশ করাই একজন উপাচার্যের কাজ হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হলে যে আদর্শ গ্র্যাজুয়েট প্রোফাইল (বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, লাইফ লং লানিং, সৃজনশীলতা, টিম ওয়ার্ক, লিডারশিপ, কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইথিক্স, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফিন্যান্স, সাসটেইন্অ্যাবিলিটি, মর্ডান টুলস, পরিবেশ ও সমাজ) থাকে তা অর্জনে শিক্ষার্থীদের অবারিত সুযোগ করে দিতে হবে এবং সে পথকে সুগম করতে হবে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য দৈনন্দিন রুটিন কাজেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন; যেমন ক্লাস-পরীক্ষার রুটিন তৈরিসহ বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সভা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কেমন হবেন বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দলীয় রাজনীতির হস্তক্ষেপ না করার জন্য মতামত আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এটা সম্ভব হলেও ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকার গঠন করবে তখন তাদের মতাদর্শের শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে মনোনীত করার প্রচেষ্টা চালাবেন- এ থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ডিন ও বিভাগীয় প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভাগ ও অনুষদের শিক্ষকরা পালাক্রমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন- যা অনেক গণতান্ত্রিক। সেই আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের মধ্যে কোনো আইনের মারপ্যাঁচ না রেখে দলমতনির্বিশেষে অধ্যাপকরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে ২ বছর মেয়াদে উপাচার্য পদের দায়িত্ব পেতে পারেন- যা হতে পারে সুশাসনের জন্য এক ধরনের সমাধান। এটা করতে পারলে সবার কাঙ্ক্ষিত মানের বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করা সম্ভব।
ড. মোহাম্মদ আলী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়