আমাদের দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোয় সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষ গোটা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সাভার এবং আশুলিয়া থেকে শুরু করে গাজীপুরের ব্যস্ত কারখানাগুলো পর্যন্ত, আমাদের পোশাক শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড, অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। এই অস্থিরতা শুধু বেতন বকেয়া বা চাকরির নিরাপত্তার দাবির জন্য নয়। এটি একটি জটিল, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ক্ষমতার লড়াই যা পুরো খাতটিকে অস্থিাতিশীল করার হুমকি দিচ্ছে।
প্রথম দেখায়, এই অস্থিরতা শ্রমিকদের দাবির দ্বারা চালিত বলে মনে হয়: বন্ধ কারখানাগুলো আবার চালু করা, বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং ন্যায্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। সাভার, আশুলিয়া, নরসিংদী এবং নারায়ণগঞ্জের মতো প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোয় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং হাজার হাজার শ্রমিক রাস্তায় নেমে এসেছে, দেশের প্রধান মহাসড়কগুলো অবরোধ করে দাবি জানাচ্ছে।
গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এটি আরও উদ্বেগজনক চিত্র প্রকাশ পায়। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এই অস্থিরতা শুরু হয়েছে, যা একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে। নতুন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়, আর শ্রমিকদের একটি বড় খেলায় পুতুল হিসেবে ব্যবহার করছে। আমরা যা দেখছি তা শুধু একটি শ্রমিক আন্দোলন নয়, এটি শিল্পাঞ্চলে কারখানা-কেন্দ্রিক ব্যবসার ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং শ্রমিকদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সরকারের পরিবর্তনের পর, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো কারখানা সংলগ্ন ব্যবসা যেমন, ঝুট ব্যবসা, খাদ্য সরবরাহ এবং অন্য পরিষেবার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই দলগুলো শ্রমিকদের একটি সুবিধাজনক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যাদের প্রকৃত অভিযোগ রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এ ধরনের কৌশল আমাদের দেশে নতুন নয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়, বৈধ শ্রমিক আন্দোলন এবং পরিকল্পিত অস্থিরতার মধ্যে সীমারেখা প্রায়ই অস্পষ্ট হয়ে যায়। শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি সম্প্রতি বলেছেন, বর্তমান আন্দোলন শ্রমিকদের প্রকৃত দাবি প্রতিফলিত করে না। 'যদি কোনো বাস্তব অভিযোগ থাকে, তবে তা সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা উচিত,' তিনি যুক্তি দেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে বাহ্যিক শক্তিগুলো তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অস্থিরতা উসকে দিচ্ছে। পরিস্থিতি যে কতটা গুরুতর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পোশাক শিল্প কেবল আমাদের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই নয়; এটি লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের জীবনরেখা। দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে, কারখানা বন্ধ থেকে গণহারে কর্মী ছাঁটাই পর্যন্ত, এবং বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর সম্ভাবনাও রয়েছে, যারা আরও স্থিতিশীল সরবরাহ চেইন খুঁজে নিতে পারে।
যেহেতু প্রতিবাদ বাড়ছে এবং সড়ক অবরোধ ও ধর্মঘট মারাত্মক বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং শিল্প পুলিশকে নিয়ে একটি যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। তবে এখানে একটি সূক্ষ্ণ রেখা রয়েছে: শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা যেমন জরুরি, তেমনই কঠোর পদক্ষেপ কোনোভাবে শ্রমিক নেতাদের বা প্রকৃত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয়।
এই সংকটের সমাধান সহজ নয়। একদিকে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে কোনো গোষ্ঠী এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে না পারে। অন্যদিকে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে শ্রমিকদের ন্যায্য চাহিদাগুলো যারা চাকরির অনিশ্চয়তা এবং বেতন বিলম্বের মতো বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন ন্যায়বিচারের সঙ্গে এবং জরুরিভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে সব পক্ষের শ্রমিক, কারখানা মালিক এবং সরকার খোলামেলা আলোচনার জন্য একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। সরকারকেও তদন্ত করে দেখতে হবে এবং কোনো গোষ্ঠী শ্রমিকদের তাদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছে কিনা তা চিহ্নিত করতে হবে। এটা শুধু শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপার নয়; এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর ভবিষ্যৎ রক্ষা করার ব্যাপার।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী দিন এবং সপ্তাহে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কেবল এই খাতের স্থিাতিশীলতা নয়, আমাদের সমগ্র জাতির অর্থনৈতিক সুস্থতাও নির্ধারণ করবে। এখানে কোনো আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আমাদের সজাগ থাকতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে যে শ্রমিকদের প্রকৃত কণ্ঠস্বর শোনা হচ্ছে এবং তাদের প্রকৃত চাহিদা পূরণ হচ্ছে।
আমরা আমাদের শ্রমিকদের রাজনৈতিক খেলায় কেবল পুতুল হয়ে উঠতে দেব না। বরং আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সব ক্ষেত্র জুড়ে একটি ন্যায্য, সুষ্ঠু এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম পোশাক শিল্প গড়ে তোলার জন্য। ঐক্য, সংলাপ এবং কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমেই আমরা এই সংকট মোকাবিলা করতে পারি এবং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারি।
এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত একটি মুহূর্ত যা প্রজ্ঞা, সংযম এবং সবার জন্য ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রম্নতি দাবি করে। আসুন আমরা সবাই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করি।
আসাদুলস্নাহ গালিভ আল সাদি
গাজীপুর