মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ

সুমাইয়া আকতার
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হলেও কার্যতভাবে প্রত্যাবাসন করা যায়নি একজন রোহিঙ্গাকেও। শুরু করা হয়নি এখনো রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ প্রত্যাবাসন কিংবা টেকসই পরিবেশের সৃষ্টির কার্যবিধি। ফলে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে রোহিঙ্গা সংকট। ফলে ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে এবং ক্যাম্পগুলোতে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও গত সাত বছরে কত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়েছে, এর সঠিক হিসাব নেই। নিয়মিত নিবন্ধন মনিটরিং, কাঁটাতারের বেড়া থাকার পরও ক্যাম্পগুলো থেকে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ পালিয়ে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যাওয়ার অভিযোগ মিলেছে। এতে করে কক্সবাজারে ভয়াবহ সামাজিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বলে দাবি স্থানীয় অধিকারকর্মীদের। কিছু টাকার বিনিময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্মনিবন্ধন পাচ্ছে। আবার জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে পাসপোর্ট পেয়ে যাওয়ার খবরও রয়েছে ইতোমধ্যে। অধিকারকর্মীরা বলছেন, একটা এলাকায় এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঘিরে রাখলেই তারা সেখানে বছরের পর বছর থাকবেন- এমন নাও হতে পারে। স্থানীয়দের মদ্যে ছড়িয়ে পড়ে স্বাভাবিক জীবনে যাওয়ার চেষ্টা করাটা স্বাভাবিক। তবে সরকারি শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার না করে বলছে-খুব বড় সংখ্যক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়েছেন, এমন না। তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। কোনো কোনো রোহিঙ্গা ঢুকছে নানা কুমতলব নিয়ে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। মিয়ানমারে সামরিক নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি একটি প্রতিবেদন দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিদিন প্রায় ৯৫টি শিশুর জন্ম হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২-১৩ লাখ পর্যন্ত বাড়তে পারে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে উলেস্নখযোগ্য সমস্যা, যা দৃষ্টিগোচরে এসেছে, এতে মিয়ানমারে এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে এই প্রত্যাবাসন এখন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেই আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। চলমান সংঘর্ষের কারণে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রম্নয়ারি মাস থেকে বিজিপি ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। গত ১৫, ২৫ এপ্রিল ও ৯ জুন তিন দফায় ৭৫২ জন বিজিপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২৩ জন বিজিপি সদস্য পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।

গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে ফুটবল খেলার মাঠে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শরণার্থীর এই আশ্রয়শিবিরের ফুটবল খেলার মাঠে রোহিঙ্গারা জড়ো হচ্ছিলেন রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর পূর্তির 'গণহত্যা দিবস' পালনের জন্য। বেলা ১১টার দিকে বিশাল মাঠটি ভরে যায় ২০-২৫ হাজার রোহিঙ্গার উপস্থিতিতে। তাদের ৮০ শতাংশ কিশোর-তরুণ। সেখানে কয়েকজন বক্তার মুখে উঠে আসে রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির কথা। জান্তা সরকারের দমন-নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গারা এখন সে দেশের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন বলে বক্তারা অভিযোগ করেন। বিদ্রোহীরা রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হত্যাও করছে তাদের। এ অবস্থায় বাংলাদেশের নতুন সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা চান রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি ছাত্রসমাজের গণঅভু্যত্থান বিষয়ে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছেন, ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হলে দুনিয়ার কোনো শক্তি টিকে থাকতে পারে না। তেমনিভাবে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামলে তাদের নিপীড়ন ও অত্যাচারের দিন শেষ হবে বলে মনে করেন। সমাবেশে পাঁচ দফা দ্রম্নত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের সহিংসতা ও হামলা বন্ধ, আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসবাসের সুযোগ তৈরি, জান্তা ও আরাকান আর্মিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুলস্নাহর গড়ে তোলা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা পিস ফর হিউম্যান রাইটসের কয়েকজন নেতা। সম্প্রতি, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে 'নাগরিকত্বেও' ফাঁদ পেতেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। উখিয়া ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা মাঝি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'আমাদের জন্য আরাকান আর্মি মোটেই ভালো না। এখন মিয়ানমার সরকার চাইছে, রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমার সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তাহলে নাগরিকত্ব দেওয়া যেতে পারে। তারা এখন রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মির সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে। কেউ কেউ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে বলে শুনেছি। এখান থেকেও (ক্যাম্প) দুই-একজন গিয়েছে। আমাদের জন্য আসলে কেউই ভালো না। আমরা চাই, নাগরিকত্ব। নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা না পেলে আমরা রাখানে ফিরব না।'

এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যায় মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, 'আরাকান আর্মি কিন্তু রোহিঙ্গাবিরোধী। তারা বুধিডং ছেড়ে রোহিঙ্গাদের চলে যেতে বলেছে। এর আগে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা আসলে পুরো রাখাইনের দখল নিয়ে রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। রোহিঙ্গারা কোন দিকে যাবে? তাদের জন্য বাংলাদেশে আসার পথই খোলা আছে। এখন ওই রোহিঙ্গারা কোন দিকে মুভ করে, তা বাংলাদেশের নজরে রাখা উচিত। তা নাহলে নতুন একটি সংকট হতে পারে।'

বাংলাদেশে সীমিত জায়গায় বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থী মানবেতর জীবন যাপন করেন। কিছুদিন পরপর আগুনে তাদের ঘর পুড়ে, ঝড়ে বিপদে পড়েন। ঘটে চলেছে সহিংসতাও। তাদের সন্তানরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, নেই কর্মসংস্থানও। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থ সহায়তার হারও চাহিদার চেয়ে ক্রমাগত কমছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে যা ৪৭ ভাগে নেমে এসেছে।

ভাগ্যবদলের চেষ্টায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করছেন অনেক রোহিঙ্গা। ইউএনএইচসিআর-এর হিসাবে, ২০২৩ সালে সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের শিবির থেকে নৌকায় সাগরপথে রওনা দেন, যাদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিলেন নারী ও শিশু। বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান পেরুতে গিয়ে মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন ৫৬৯ জন, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীনকে যুক্ত করলে 'সমাধান সম্ভব' বলে আশা করা যায়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকটকে অন্য কোনো সংকটের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা প্রধানকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তবে মিয়ানমারের কিছু সংখ্যক সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসায় খুব দ্রম্নত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও যথাযথ মর্যাদায় প্রত্যাবাসন করাও খুব একটা সহজতর হবে না। এতে আরও কালক্ষেপণ করাই এখন উচিত বলে মনে হচ্ছে। সাবেক সরকারের শাসনামলে এই সমস্যা সমাধানে এ বছরের মার্চে 'জয়েন্ট রেসপন্স পস্ন্যান' বা জেআরপির উদ্বোধন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান করা হয়।

এই জেআরপির মাধ্যমে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ এবং ভাসানচরে থাকা ১৩ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ৮৫২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়। দীর্ঘ সাত বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দীর্ঘমেয়াদি এই সংকট নানা দিক দিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলছে। বিশ্বজুড়ে চলমান অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এই সমস্যা যেন গুরুত্ব না হারায়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে দেশে ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা প্রধানের ওপর রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমস্যা ও টেকসই প্রত্যাবাসন একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হোক :নিশ্চিত হোক রোহিঙ্গাদের নায্য অধিকার।

সুমাইয়া আকতার

শিক্ষার্থী

বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে