শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সেভেন সিস্টার্স বাংলাদেশ-ভারত ভূ-রাজনীতির অন্যতম ক্ষেত্র

উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্সের অধিভুক্ত ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাকি চারটি রাজ্যেও বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
খন্দকার আপন হোসাইন
  ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সেভেন সিস্টার্স বাংলাদেশ-ভারত ভূ-রাজনীতির অন্যতম ক্ষেত্র

বাংলাদেশের দু'টি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত দুইশ' একাত্তর কিলোমিটার। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত চার হাজার একশ' ছাপ্পান্ন কিলোমিটার। যার মধ্যে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের (নর্থ ইস্ট রিজিওন সংক্ষেপে এনইআর) সঙ্গেই রয়েছে এক হাজার আটশ' একচলিস্নশ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত। ভারতের এনইআর কৌশলগতভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের মোট অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ২৮টি। এই ২৮টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সাতটি রাজ্যকে একত্রে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। দুই লাখ বাষট্টি হাজার দুইশ' চুরাশি বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট সেভেন সিস্টার্স ভারতের মোট আয়তনের সাত শতাংশজুড়ে বিস্তৃত। ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজুরাম, অরুণাচল ও নাগাল্যান্ড- এই সাতটি রাজ্যকে সর্বপ্রথম সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিতি এনে দেয় ত্রিপুরার সাংবাদিক সংগঠক জ্যোতি প্রকাশ সাইকেরিয়া। সাংবাদিক জ্যোতি প্রকাশ ল্যান্ড অব সেভেন সিস্টার্স নামক একটি বই লিখেন। বইটিতে তিনি সেভেন সিস্টার্সের সাতটি অঙ্গরাজ্যের ভূ-রাজনীতি ও আন্তঃসম্পর্ক ফুটিয়ে তোলেন। সেভেন সিস্টার্স দৃশ্যত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থা (আসিয়ান) এবং চীনের মধ্যকার একটি করিডোর। কিন্তু দুর্বল অবকাঠামো এবং ভূমিবেষ্টিত অঞ্চলে অবস্থানের কারণে সেভেন সিস্টার্স তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে। আপাতদৃষ্টিতে সেভেন সিস্টার্সকে ভারতের মূল ভূখন্ডের তুলনায়, দেশের উত্তর-পূর্ব অংশের একটি অবহেলিত অঞ্চল বলে মনে হয়।

উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্সের অধিভুক্ত ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাকি চারটি রাজ্যেও বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

সেভেন সিস্টার্সে বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত গত এক যুগ ধরেই দৃশ্যমান। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ সম্ভব হলে বাংলাদেশ ও ভারতের সাত রাজ্যের নাগরিকরাও উপকৃত হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরা ও মিজোরামে দীর্ঘতম স্থল ও নদীভিত্তিক সীমানা রয়েছে। এছাড়া ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দর রয়েছে। বাংলাদেশের পণ্য এই তিন রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশ করে। জানা গেছে, সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোতে তৈরি পোশাক, লোহা, সিমেন্ট, টিন, ইলিশ, শুকনো খাবার, জুস, চিপস, শাড়ি, কাঁচা পাট, মিনারেল ওয়াটার, বিভিন্ন ধরনের সস এবং স্ন্যাকস, আইসক্রিম, ইমার্জেন্সি লাইট, কনডেন্সড মিল্ক, মিষ্টান্নসামগ্রী, তুলা, পস্নাস্টিকের জুতা, স্যান্ডেল, পস্নাস্টিকের টেবিল, রান্নাঘরের জিনিসপত্র, জামদানিসহ আরও বেশ কিছু বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অর্থনীতি গবেষকদের ধারণা বাংলাদেশের সঙ্গে সেভেন সিস্টার্সের ঘনিষ্ঠ আর্থনীতিক একীকরণ ও সংযোগ ঘটাতে পারলে এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রস্থলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংযোগ শক্তিশালী হবে।

বাংলাদেশে প্রায় ষোলো বছরের আওয়ামী শাসনের অবসানের পরপরই ভারতের সংবাদমাধ্যম এনিডিটিভির এক সাক্ষাৎকারে অংশ নেন নোবেলবিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, 'বাংলাদেশকে কেউ অস্থিতিশীল করতে চাইলে চারদিকে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে। প্রতিবেশী মিয়ানমার, ভারতের সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়বে অস্থিরতা।' বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওই সাক্ষাৎকারের পর থেকেই সেভেন সিস্টার্স নেটিজেনদের মাঝে টক অব দ্য টাউন হিসেবে বিরাজ করছে। এমনিতেই সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ভারত সরকারের যথেষ্ট দুঃশ্চিন্তা রয়েছে। কেননা, এই সাতটি অঙ্গরাজ্যে শতাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী দল রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করে দাবিয়ে রাখে ভারত। সেভেন সিস্টার্স সংলগ্ন কোনো স্বাধীন দেশ যদি এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকানি দেয় সেটি ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে আরও বড় দুঃশ্চিতার কারণ হবে।

দীর্ঘদিন ধরে নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল, মিজোরাম, আসাম ও মিয়ানমারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে নাগা স্বাধীনভূমি বা 'নাগালিম' গড়ার ডাক দিয়ে আসছে সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনএসসিএন এই দাবিতে অনেক দিন ধরেই সহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের দিন মণিপুর রাজ্যে নাগা জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। সেদিন রাজ্যের দূরদূরান্ত থেকে কয়েক হাজার নাগা জনগোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হয়ে 'নাগা স্বাধীনতা দিবস' পালন করে। ওই ঘটনার পর থেকে ভারত সরকার সচেতনভাবেই স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রম্নপ মুইভা গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া শান্ত নাগাল্যান্ড। কিন্তু পতাকা উত্তোলনে যে ভীতি ও উদ্বেগ ছড়িয়েছে তাতে পার্শ্ববর্তী কোনো রাষ্ট্রের উসকানি সহজভাবে নেবে না ভারত।

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার মাঝে সেভেন সিস্টার্সের স্বাধীনতা বিষয়ক আলোচনা এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্স বিষয়ক টকশো ভারতের সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সাবেক আওয়ামী সরকারের সঙ্গে বিজেপি সরকারের সম্পর্ক, সীমান্তে নিরীহ বাঙালি হত্যা, তিস্তা চুক্তি, ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে ভারত সরকারের বৈষম্য এবং সম্প্রতি বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে সাধারণ ছাত্রসমাজ অত্যধিক ভারতবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার মাঝে স্স্নোগান উঠেছে 'পেতে চাইলে মুক্তি, ছাড়ো ভারত ভক্তি'। 'বন্যায় যদি মানুষ মরে সেভেন সিস্টার্স থাকবে নারে'। 'আমরা সবাই বাবর হব সেভেন সিস্টার্স স্বাধীন করব'। বিএনপি মনোনীত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নামে এমন স্স্নোগানও নতুন করে সেভেন সিস্টার্সকে আলোচনায় টেনে আনছে। বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার মূল ব্যক্তিটি হলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। জানা গেছে, সেভেন সিস্টার্সের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে সরবরাহ করার জন্য সাতাশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই ১০ ট্রাক অস্ত্র আনিয়েছিলেন বাবর। উদ্দেশ্য ছিল এই ১০ ট্রাক অস্ত্র দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীগোষ্ঠী সেভেন সিস্টার্স স্বাধীন করার সংগ্রাম করবে আর ভারত সরকার তাদের দমন করতে ব্যস্ত থাকবে। ফলে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করবে না ভারত। এই ঘটনার পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পালা বদল হলে বাবর জেলে চলে যায় এবং ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটিনাটি অন্তরালে চলে যায়।

অনবরত ভারতবিদ্বেষী স্স্নোগান ও সেভেন সিস্টার্স স্বাধীন করার হুঁশিয়ারি যদি ভারত আমলে নেয় সেটি কি বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য ভালো হবে? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে 'কারও সঙ্গে শত্রম্নতা নয় সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব'। এই নীতিই কেবল বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যেন কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত না হয় সেদিকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কেননা, সেভেন সিস্টার্স বিষয়ক একটি ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা গুজব আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। দেশের স্বার্থ বিবেচনা করেই প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংযুক্ত। বাংলাদেশ-ভারত পারস্পরিক কল্যাণকর অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর আরও জোর দিতে হবে। দুই অঞ্চলের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও সম্প্রসারণের জন্য দেশ দু'টির যোগাযোগ এবং বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হবে। ভারতের এনইআর হতে পারে বাংলাদেশি তাজা শাকসবজি, মাছ, সামুদ্রিক খাবার এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের একটি ভালো বাজার। এজন্য বাজারের প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত করতে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে উত্তর-পূর্ব প্রাদেশিক সরকার থেকে প্রতিশ্রম্নতি নিতে হবে। রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনার জটিলতা একটি ঘটনা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি করার প্রতিশ্রম্নতি দিলেও পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক সরকার এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিকেশন গ্যাপ। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুধু রাষ্ট্র সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকুক, তা চাই না বরং বিগত সময়ে যা সম্ভব হয়নি সে সব বিষয়েও ইউনূস সরকারের সাফল্য প্রত্যাশা করি।

খন্দকার আপন হোসাইন : গবেষক, সংগঠক ও শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে