শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমান স্মরণে

নোমান ভাই ছিলেন নম্র স্বভাবের, শান্ত প্রকৃতির ও পষ্টভাষী। তার অমায়িক ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হতো। সাহিত্য ও জীবন সম্পর্কে তার ছিল গভীর মমত্ববোধ।

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সুলতান-উজ-জামান খান
১৯৪৭-এর শেষ দিকে আমি তদানীন্তন ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে পড়তে আসি। সে সময় প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমান সাহেবের ছোট ভাই মোহাম্মদ ফারুক আমার অন্যতম সহপাঠী ছিলেন। ফারুকের সঙ্গে অল্পকালের মধ্যেই আমার বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিল। আমাদের ঘনিষ্ঠতার প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছিল সাহিত্যের প্রতি উভয়ের অভিন্ন আসক্তি। আমাদের সমকালের কলেজীয় সহপাঠীদের মধ্যে বেশ কিছু লেখক, কবি এবং সাহিত্যরসিক ছিলেন, যারা পরবর্তীকালে সুনাম অর্জন করেন। এদের মধ্যে প্রয়াত হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ওবায়দুলস্নাহ খান এবং সাইয়িদ আতিকুলস্নার নাম উলেস্নখযোগ্য। বিবিসি খ্যাত সিরাজুর রহমানও লেখালেখি করতেন এবং আমাদের সহপাঠী ছিলেন। বন্ধুবর ফারুকের সাহিত্যের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। যেমনটি আমার মধ্যে ছিল। সাহিত্য সৃষ্টির চেয়ে সাহিত্যের রসাস্বাদনেই ছিল আমাদের অধিক প্রবণতা। সে যুগে আমরা প্রচুর আড্ডা দিতাম। রবীন্দ্রসাহিত্য ও নজরুল কাব্যের ওপর হতো বিস্তর আলাপ। এই দু'জন সাহিত্যিক দিকপালের ওপর ফারুকের ভালো পড়াশোনা ছিল বলে মনে পড়ে। ওদের সম্পর্কে প্রায়ই তুলনামূলক আলোচনা ও তর্কাতর্কি হতো আমাদের মধ্যে, এ কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আমাদের সেই নবীন বয়সে কোন কবি কার চেয়ে বড়- এ ধরনের অহেতুক বচসায় আমরা প্রায়ই জড়িয়ে পড়তাম। অচিরেই জানতে পারি যে, ফারুকের সাহিত্য রসিকতার মূল উৎস ছিলেন তার অগ্রজ মোহাম্মদ নোমান সাহেব। যতদূর মনে পড়ে, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য স্নাতকোত্তর ক্লাসে অধ্যয়নরত ছিলেন। ফারুকের শিক্ষাজীবনে তার বড় ভাইয়ের প্রভাব ছিল গভীর। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর সাহিত্যকেই তার মুখ্য পাঠ্য হিসেবে বেছে নেয় এবং ভাইয়ের অনুসরণে আজীবন অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। প্রথম কবে নোমান ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সন-তারিখ এখন মনে পড়ে না। তবে এ কথা মনে আছে স্পষ্ট যে, তার চেহারার সঙ্গে আমার অনেকটা সাদৃশ্য ছিল, বিশেষত আমাদের দুজনের গাত্রবর্ণে। ফারুক অবশ্য এ নিয়ে দু'একবার আমার সঙ্গে ঠাট্টাও করেছে। নোমান ভাই ছিলেন নম্র স্বভাবের, শান্ত প্রকৃতির ও পষ্টভাষী। তার অমায়িক ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হতো। সাহিত্য ও জীবন সম্পর্কে তার ছিল গভীর মমত্ববোধ। \হএকজন চমৎকার ভদ্রলোক হিসেবে তার ছিল বিস্তৃত পরিচিতি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি, তবুও যখনই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে তার আন্তরিক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। যারা নোমান ভাইকে জানতেন তারা সবাই তার মাঝে এক জ্ঞানতাপসকে খুঁজে পেতেন। দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি উলেস্নখযোগ্য সাফল্য ও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার সহকর্মীরা এবং ছাত্ররা তাকে গভীরভাবে সম্মান করত। আমাদের দেশ ও জাতির চরম দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বস্তরেই এক করুণ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ক্যাম্পাস, অরাজকতা ও দুর্নীতি সমাজের অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, আমরা তা প্রতিনিয়ত অনুধাবন করছি। শিক্ষা এবং সংস্কৃতি- যা কিনা সুশীল সমাজের অপরিহার্য বুনিয়াদ, আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের সম্মুখীন। এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থ্থিতিতে সৎ, জ্ঞানী ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাকের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। নোমান ভাই ছিলেন এ অঙ্গনের একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি, তাতে সন্দেহ নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অমন মানুষের সংখ্যা সমাজে বিরল হয়ে উঠেছে। প্রয়াত নোমান ভাইয়ের পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করতে গিয়ে বারংবার আমার মনের মধ্যে আজ যে প্রশ্নটি জাগে তা এই যে, ওরা যেমন এক পরিশীলিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করেছিলেন ও শিক্ষাঙ্গনে যে উদারনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার পুনরুদ্ধার অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে কি? সুলতান-উজ-জামান খান : সাবেক সচিব